শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নজরুলের প্রেম--

রহস্যময়ীর প্রেমে পাগল

রহস্যময়ীর প্রেমে পাগল

জ্ঞানের গভীরতা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং আধুনিক নারী বলতে যা বোঝায় তার সব উপাদান ফজিলাতুন্নেসার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। আর এসবই বুঝি আকৃষ্ট করেছিল নজরুলকে। প্রথম দেখাতেই যে কবি তার প্রেমে পড়ে যান এ কথা শুধুমাত্র তিনজনই জানতেন। ফজিলাতুন্নেসা, কাজী মোতাহার হোসেন এবং কবি নিজে। তবে কবি এখানে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হন। তবে বারবারই ফজিলাতুন্নেসার প্রভাব তার জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে।

কবি বিভিন্নভাবে কাজী মোতাহার হোসেনকে অনুরোধ করেছেন ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে দেখা করার। তবে দেখা করার সুযোগ মেলেনি। মাঝে মধ্যেই চিঠি লিখতেন, উত্তর আসত না। অনেকদিন পর একদিন চিঠির উত্তর আসে, সেখানে লেখা থাকে তাকে আর কোনো চিঠি না লিখতে। বিদ্রোহী কবিতায় আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণতূর্য’।

প্রেম ও বিদ্রোহ যে সমানতালে চলতে পারে তার প্রমাণ মিলতে এই একটি লাইনই বুঝি যথেষ্ট। এই দ্রোহ এবং প্রেমকে ধারণ করে এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কেবল নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। কবির জীবনে প্রেম এসেছে বারবার। এই প্রেমেই তার কবিতা এবং গানের অন্যতম প্রেরণাদায়ক। আবার প্রেমে ব্যর্থ কবি হৃদয়ে বেজে উঠেছে বিরহের সুর।

কবির জীবনে প্রেমের অধ্যায়ে বহু নারীর কথা উঠে আসলেও মূলত তিনজনের কাছে কবির প্রেম নিবেদনের প্রমাণ মেলে। এরা হলেন নার্গিস, প্রমীলা এবং ফজিলাতুন্নেসা। আজকের আলোচনা ফজিলাতুন্নেসাকে নিয়ে যাকে প্রচন্ড ভালবাসা সত্ত্বেও আপন করে পাননি কখনো কবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসা। বিয়ের পর নাম হয়েছিল ফজিলাতুন্নেসা জোহা, তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান।

আরও পড়ুনঃ  পিএফআই সিকিউরিটিজের লেনদেন স্থগিত হয়নি

ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায় কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে, ‘ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এমএ এবং একজন উচুঁদরের বাক্‌পটু মেয়ে’। ফজিলতুন্নেসার জন্ম ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে গণিত শাস্ত্রে এমএতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯২৮ সালে বিলেতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। উপমহাদেশে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিলাত থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন।

বিদেশে পড়ার সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে খুলনা নিবাসী আহসান উল্ল্যাহর পুত্র জোহা সাহেবের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেছার পরিচয় হয়। পরে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯২৮ সালে কাজী নজরুলের দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরের সময় ফজিলতুন্নেসার পরিচয় ঘটে। ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভাগ্য বলতে পারেন এবং তিনিও তার হাত নজরুলকে দেখাবার ইচ্ছা হয়।

এভাবে ফজিলতুন্নেসা ও তার বোন সফীকুননেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে ফজিলতুন্নেসার বাসায়। কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে জানা যায়, সেই দিন রাতেই নজরুল ফজিলতুন্নেসার ঘরে যান এবং প্রেম নিবেদন করেন। ফজিলতুন্নেসা নজরুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে ‘বর্ষা-বিদায়’ নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী যেটির নাম পরে দেওয়া হয়  তুমি মোরে ভুলিয়াছ।

আরও পড়ুনঃ  যুক্তরাষ্ট্রের কয়লা খাতে মন্দা

১৯২৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিতে কবি লিখছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভাব ছিল sadness-এর। কিছুতেই sad হতে পারছিলাম না। কেবল ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু আজ ডুবেছি বন্ধু! একেবারে নাগালের অতলতায়।’ কবি তার সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা উত্তমগুলির সংকলন সঞ্চিতা তার নামে উৎসর্গ করার অনুমতি চেয়েও পাননি।

আমরা জানি, সঞ্চিতা শেষাবধি রবীন্দ্রনাথের নামে উৎসর্গীকৃত। গণিতের এই ছাত্রীটি নজরুলকে উৎসর্গের অনুমতি দেন নাই। এ কথা সত্য যে কবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন যা জানা যায় কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা কবির এক পত্রে। প্রত্যাখ্যাত কবি কাজী মোতাহার হোসেনকে লিখেন, ‘গণিতজ্ঞ লোকেরা বড্ডো কঠোর নিষ্ঠুর হয়..ওদের কেবলই intellect, heart নেই। আমাদের যেমন কেবল heart, intellect নেই। একেবারে যারে বলে ‘সিলি ফুল’।

শেষমেশ ফজিলাতুন্নেসাকে নিয়ে তৈরি সমস্ত অভিমান কবি ঝেড়েছেন গণিতের ওপর। কবির ভাষায় ‘কোনো নারী–সুন্দরের উপাসিকা নারী–কোনো অঙ্কশাস্ত্রীর কবলে পড়েছে, এ আমি সইতে পারি নে। নারী হবে সুন্দরের অঙ্কলক্ষী, সে অঙ্কশাস্ত্রের ভাঁড়ার রক্ষী হবে কেন?’ অপর একটি চিঠিতে কবির উতলাভাব আরও উতলা হয়ে পড়েছে, ‘আমার এতদিনে ভারী ইচ্ছে করছে অঙ্ক শিখতে। আমি যদি বিএ-টা পাস করে রাখতাম, তাহলে দেখিয়ে দিতাম যে, এমএতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কবিও হতে পারে ইচ্ছে করলে।’

তারপরেও ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তার ভালোবাসা মরে যায়নি। তাই নজরুল তার বন্ধুকে লিখেছেন, ‘যেদিন আমি ঐ দূর তারার দেশে চলে যাব–সেদিন তাকে বলো এই চিঠি দেখিয়ে– সে যেন দুটি ফোঁটা অশ্রু তর্পণ দেয় শুধু আমার নামে।’

আরও পড়ুনঃ  বাংলার মাটি ও গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু

প্রথম পরিচয়ের পর থেকে কবি তাঁর প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল হলেও ফজিলাতুন্নেসা সে ডাকে সাড়া দেন নি। কবি তাকে নিয়ে একের পর এক গান-কবিতা লিখতে লাগলেন। বন্ধু মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে চিঠি লিখে তার খবরাখবর জানতে চাইতেন। ফজিলাতুন্নেসার প্রচণ্ড উপেক্ষার প্রেক্ষাপটে কবি বেশ কিছু কবিতা-গান রচনা করেন।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ কবিতা ‘এ মোর অহঙ্কার’। এতে কবি প্রিয়াকে না পাওয়ার বেদনাধারা বর্ণনা করেছেন- ‘নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার/ তোমায় আমি করব সৃজন, এ মোর অহঙ্কার।/ এমনি চোখের দৃষ্টি দিয়া/ তোমায় যারা দেখল প্রিয়া/ তাদের কাছে তুমি তুমিই। আমার স্বপনে/ তুমি নিখিল রূপের রাণী মানস-আসনে! …।’

উচ্চশিক্ষার জন্য ফজিলাতুন্নেসা বিলেত পাড়ি জমান। তার বিদেশযাত্রা উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে কবি তখন গেয়ে শোনান তার বিখ্যাত গানটি-

‘জাগিলে পারুল কিগো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে,

উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে॥

চলিলে সাগর ঘু’রে

অলকার মায়ার পুরে

ফোটে ফুল নিত্য যেথায়

জীবনের ফুল্ল-শাখে॥

আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,

জাগিছে বন্দিনীরা, টুট ঐ বন্ধ কারা।

থেকো না স্বর্গে ভুলে,

এ পারের মর্ত্য কূলে,

ভিড়ায়ো সোনার তরী

আবার এই নদীর বাঁকে॥

একই উপলক্ষে ‘বর্ষ বিদায়’ কবিতাও রচনা করেন। এটি তাঁর বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেদিক থেকে বলা যায় ফজিলাতুন্নেসা কবির গান ও কবিতা রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রেরণাদায়ক। ফজিলাতুন্নেসা কর্তৃক বার বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও কবি পাগলের মতো ভালবেসেছিলেন তাঁকে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন