শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেহেরপুরের নাইটিঙ্গেল রোজ

মেহেরপুরের নাইটিঙ্গেল রোজ

আধুনিক নার্সিংয়ের জননী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো ব্রিটিশ নাগরিক জিলিয়ান এম রোজ চার দশক ধরে মেহেরপুরের প্রত্যন্ত জনপদে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে চলেছেন। বয়সের ভারে চলার শক্তি কমে গেলেও দমে যাননি আজও। মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে চলেছেন অবিরাম। বাংলাদেশ আর দেশের মানুষকে হৃদয়ে ধারন করেছেন একান্ত আপন করে। রোজের শেষ ইচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এদেশের মাটিতেই চিরশয্যা পাতবেন। রোজের মানবসেবার স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠন সম্মাননা আর নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও আজও তা আলোর মুখ দেখেনি।

রোজের দেয়া তথ্যমতে, তিনি ১৯৬৪ সালে প্রথম বরিশালে আসেন। এরপর এদেশের মাটি, মানুষ আর প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখে মুগ্ধ হন। মাঝে মাঝেই তিনি ইচ্ছেমতো বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে তিনি স্বজনদের টানে ব্রিটেনে ফিরে যান। তবে বাংলাদেশের হৃদয়ের টান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে স্বাস্থ্যসেবিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন।

নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে জিলিয়ান এম রোজ প্রথমে খুলনা, পরে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর হাসপাতালে আসেন। সেখানেই শুরু করেন মানবসেবার কাজ। মানুষের সেবা দিতে গিয়ে তার আর সংসার পাতা হয়নি। চিরকুমারি রোজ গত ৫৮ বছর ধরে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রোজ কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলেন না। নিবিড়ভাবে রোগীদের সেবা করাতেই নিমগ্ন থাকেন সব সময়।

আরও পড়ুনঃ  বিশ্ববাজারেও দুর্মূল্য স্বর্ণ 

তবে রোজের হৃদয়জুড়ে শুধুই বাংলাদেশ আর এদেশের মানুষ। ভিনদেশি নাগরিক হয়েও দেশের মানুষকে পরম মমতা ও যত্নে সেবা দিয়ে চলেছেন বছরের পর বছর। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারায় অনেক খুশি রোজ। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন সেবা দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি তার। তিনি নিজ উদ্যোগে মুজিবনগরে গড়ে তুলেছেন বৃদ্ধাশ্রম। চলনে-বলনে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে ওঠা নিভৃতচারী রোজের এখন একটাই চাওয়া বাংলার মাটিতে শেষ বিদায়।

স্বজনদের চাপাচাপিতে ২০১৭ সালে জিলিয়ান এম রোজ ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষ ও মাটির মায়ায় সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। পরিবার তাকে নিজে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য দফায় দফায় চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি। বার বারই তাদের নিরাশ করেছেন।

জিলিয়ান রোজ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সরকার যদি তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়, তাহলে তার সম্মান বাড়বে। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এভাবে সেবা দিয়ে যাবেন। বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে গিয়ে রোজকে দেখা যায় একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যেতে। হাসিভরা মুখে রোগীদের সঙ্গে কথা বলছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। কাজের ফাঁকে ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কখনও আবার ছুটে যাচ্ছেন নিজহাতে গড়া বৃদ্ধাশ্রমে।

বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের সিনিয়র নার্স নীলসুরি সরিন দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, জিলিয়ান রোজ রাত নাই দিন নাই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। নিজের জন্য কিছুই করেন না। নেই কোনো অহংকার। সাদাসিদে পোশাক পরেন, নিরামিষ খান। তার কাছ থেকে মানুষ হয়ে ওঠার গুণাবলী কিছুটা অর্জন করেছি।

আরও পড়ুনঃ  ভাষা ব্যবহারে সতর্কতা ও পরিমিতি বোধ

সূত্রমতে, বিগত ২০০১ সালে ইংল্যান্ডের রাণীর পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন হাইকমিশনার বল্লভপুরে গিয়ে জিলিয়ান রোজকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওবিই বা অর্ডার অফ দ্য বিৃটিশ এম্পায়ার উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন।

মিশনারীতে কর্মরতরা জানান, মেহেরপুরের মানুষ অনেকবার রোজকে সম্মাননা দিয়েছেন। তবে বার বারই উঠে এসেছে তাকে নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়। কিন্তু আজও তার ভাগ্যে নাগরিকত্ব জোটেনি। এমনকি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও রোজকে নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে আজও তার নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়ে সুরাহা হয়নি।

বল্লভপুরের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বাবুল মল্লিক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, জেলাবাসী রোজকে নাগরিকত্ব দেবার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তিনি নিজেও বিগত ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসনের কাছে রোজের পক্ষে আবেদন করেছেন।

জানতে চাইলে মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খান বলেন, বাংলাদেশকে যে মানুষটি এতো ভালোবেসেছেন নিশ্চয়ই বাংলাদেশও তাকে ভালোবাসবে। আমরাও তাকে ভালোবাসি। তাকে বাংলাদেশের মানুষ মনে করি। তিনি বলেন, জিলিয়ানের নাগরিকত্বের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন