ঢাকা | সোমবার
১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভাষা ব্যবহারে সতর্কতা ও পরিমিতি বোধ

ভাষা ব্যবহারে সতর্কতা ও পরিমিতি বোধ

আমরি বাংলাভাষা—

আলাপচারিতায় অপভাষা ব্যবহারের যে প্রচলন শুরু হয়েছে এটা রোধ করার পদক্ষেপ জরুরি। কেননা অহরহ অপভাষা ব্যবহারের কারণে অনেকক্ষেত্রে সে শব্দ বা ভাষা বিনোদনমূল্য অর্জন করে ফেলে। আর মানুষ যেখানে বিনোদন বা আনন্দ পাবে সেটার চর্চাই বেশি করবে। আরো একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে কটাক্ষ করতে হলেও ভাষার অপব্যবহার করা ঠিক নয়। কেননা বিদ্রুপাত্মক বা ব্যাঙ্গাত্মক শব্দে কারো ভুল শোধরানো যায় না। অনেকক্ষেত্রেই কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার কৌশল হিসেবে এ জাতীয় শব্দ ও ভাষার প্রয়োগ করা হয়। এটা খুবই অপেশাদার ও অগ্রহণীয় পথ। কুবাক্য ও কুকথা কখনোই কাউকে শোধরাতে পারে না। অন্ধকার যেমন অন্ধকার দূর করতে পারে না, ঘৃণা দিয়ে যেমন ঘৃণা দূর করা যায় না ঠিক সেরকম ভাবেই বিদ্রুপ বা তাচ্ছিল্যর ভাষা মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় না।

বাইশ বছর আগে অভিবাসী হয়ে প্রথম যখন ভিনদেশি এয়ারপোর্টে নামলাম তাদের  অভিবাদন জানানোর ভাষা ও ভাষার শাব্দিক অলংকরণ শুনে অভিভুত হয়ে পড়েছিলাম। ‘ইয়েস-প্লিজ’, ‘নো-থ্যাংকস’ বা ‘টেক-কেয়ার’ শব্দগুলো যে পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতায় নতুন মাত্রা আনে সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। পরে দেখি সাধারণ কথাতেও শব্দের সুন্দর বিন্যাস ও পরিমিতি বোধ থাকে যা চর্চা ছাড়াও তাদের কৃষ্টিরই অংশ। প্রসঙ্গটা এ কারণে যে, বাংলাভাষা ও ভাষার ব্যবহারে  অসংলগ্নতা খুব নজরে পড়ছে ইদানিং।

বাংলা ভাষায় যথেষ্ট পরিমাণ নম্র ও বিনয়ী শব্দের বিপুলতা থাকা সত্ত্বেও কেন জানি  সাধারণ কথনে বা  দৈনন্দিন বাক্যলাপে তার যথাযথ ব্যবহার করা হয় না। সোজাভাবে বলা যায় ভাষা ব্যবহারে আমরা সতর্কতা বা পরিমিতি বোধ চর্চা করি না। ভাষার যথার্থ অনুশীলন ভাষার মাধুর্যতা বাড়ায়।

বর্তমানে বাংলা শব্দের অপরিমিত ব্যবহার একটু বেশিই যেন চোখে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে যদি ইংরেজি ভাষার ব্যবহার তুলনা করি তাহলে বুঝা সহজ হবে। যেমন ইংরেজি ভাষায় ‘ইয়েস-প্লিজ’, ‘নো-থ্যাংকস’ বা ‘টেক-কেয়ার’ জাতীয় শব্দগুলো অনেকটা একক শব্দ হিসেবেই গতানুগতিক কথোপকথনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আলাদা করে উপলব্ধি করতে হয় না যে এটা সৌজন্যতাবোধের অংশ। ইংরেজি ভাষার গঠনশৈলীতে এ ধরণের শব্দের ব্যবহার নৈমত্তিক কথার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত। বাংলা ভাষায় এ জাতীয় সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার থাকার পরও আমরা যেকোনো কারণেই হোক তা ব্যবহার করতে চাই না বা করি না।  

আরো লক্ষণীয় একটা ব্যাপার হচ্ছে, কথোপকথন এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও ভাষা ব্যবহারে অনেকক্ষেত্রেই সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে না এবং পরিশুদ্ধ বা চলতি ভাষার চেয়ে অপভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি জন্মাচ্ছে। কারণ হিসেবে  সম্ভবত  আমরা মনে করি যে,  পরিশুদ্ধ ভাষা বুঝি কেবল সাহিত্য, উপস্থাপনা বা ফর্মাল আলোচনার জন্য। এজন্য গল্প, আড্ডা, সমাজ মাধ্যম অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ব্যাপারে বেশ অসংলগ্নতা লক্ষণীয়। তার ওপর স্মার্টফোন ও ডিজিটাল গণতন্ত্রের কারণে বিষয়টা চর্চিত হচ্ছে আরো অবাধে।

ভাষা সামাজিক অস্তিত্বের অন্যতম বাহক। ভাষা বা শব্দের মাধ্যমে মানুষ মনের ভাব আদান প্রদান করে, অনুভূতি প্রকাশ করে। সেই ভাষার ব্যবহার ও অনুশীলন  যদি পরিমার্জিত ও চিন্তাকর্ষক না হয় তাহলে এটি নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে ডিজিটাল গণতন্ত্র শুরু হবার পর থেকে বাক স্বাধীনতার নামে অপভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছে ব্যাপকহারে। কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের অনুভুতি ও মনোভাব প্রকাশে যে সব শব্দ বা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে অনেকক্ষেত্রেই তা গ্রহণযোগ্য  নয়। এমনকি সহনীয়ও নয়। কিন্তু কোনো সেন্সর কিংবা বাধা না থাকায় এসব সামাল দেয়া বা রোধ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। তার ওপর মানুষের রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, বিশ্বাস প্রকাশের বিশ্বস্ত ও ভরসার জায়গাগুলো সীমিত হয়ে যাওয়ার কারণে অনুভূতির উদগীরণ হয় ভাষার ভয়ঙ্কর অপপ্রয়োগে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো আর বিশ্বস্ত বন্ধু, স্বজন, কিংবা শুভার্থীর সঙ্গে মনপ্রাণ খুলে কথা বলা এক নয়। তাই  এই অভব্যতা অবলীলায় বিস্তৃত হচ্ছে। কেননা কাউকে পাওয়া না গেলে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ উদগীরণ সবচে সহজ পথ এখন। অপভাষা ব্যবহারের এই আগ্রহ ও বিপুলতা আসলে কৃষ্টগত  দৈন্যতারই নিদর্শন। তাছাড়া অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই অপভাষা ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে মূল ভাষার মর্যাদাহানি করে।  

আলাপচারিতায় অপভাষা ব্যবহারের যে প্রচলন শুরু হয়েছে এটা রোধ করার পদক্ষেপ জরুরি। কেননা অহরহ অপভাষা ব্যবহারের কারণে অনেকক্ষেত্রে সে শব্দ বা ভাষা বিনোদনমূল্য অর্জন করে ফেলে। আর মানুষ যেখানে বিনোদন বা আনন্দ পাবে সেটার চর্চাই বেশি করবে। আরো একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে কটাক্ষ করতে হলেও ভাষার অপব্যবহার করা ঠিক নয়। কেননা বিদ্রুপাত্মক বা ব্যাঙ্গাত্মক শব্দে কারো ভুল শোধরানো যায় না। অনেকক্ষেত্রেই কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার কৌশল হিসেবে এ জাতীয় শব্দ ও ভাষার প্রয়োগ করা হয়। এটা খুবই অপেশাদার ও অগ্রহণীয় পথ। কুবাক্য ও কুকথা কখনোই কাউকে শোধরাতে পারে না। অন্ধকার যেমন অন্ধকার দূর করতে পারে না, ঘৃণা দিয়ে যেমন ঘৃণা দূর করা যায় না ঠিক সেরকম ভাবেই বিদ্রুপ বা তাচ্ছিল্যর ভাষা মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় না।

সেজন্য ডিজিটাল গণতন্ত্রের নামে আমরা যেন অশিষ্টতার অনর্গল প্রয়োগে অভস্ত না হই। কালের প্রবাহে মানুষ এখন বহুজাতিক মিশ্র কালচারে অভ্যস্ত। তবুও নিজ সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি মানুষের একটা দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই দৈনন্দিন কথনে ভাষার পরিশুদ্ধ ব্যবহার বাড়ানো দরকার। ব্যবহারের এই গতিশীলতা ও উপর্যুপরি অনুশীলন মূলত ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। আর সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় ভাষার পরিমার্জিত অনুশীলনে। না হলে ধীরে ধীরে মূল ভাষার ভিত্তি নড়বড়ে হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই কথোপকথন ও সাধারণ চর্চায় সতর্ক ও পরিমিত ব্যবহারে ভাষাকে করতে হবে আরো মাধুর্যময়। পরিশুদ্ধ ভাষা চর্চা অর্থাৎ ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার আচরণেও আনতে পারে সতর্কতাবোধ। আর এটি যে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক তা বুঝতে দূরদর্শী চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন