শচীন দেববর্মণ ছিলেন বাংলা ও হিন্দি গানের কিংবদন্তিতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গায়ক এবং লোকসঙ্গীত শিল্পী। তিনি এসডি বর্মণ, শচীনকর্তা নামে এবং ভিন্ন কণ্ঠস্বর ও জাদুকরী সুর সৃষ্টির জন্য শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত।
এসডি বর্মণ ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লার এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববাহাদুর ছিলেন ত্রিপুরা রাজকুমার এবং মা নির্মলা দেবী ছিলেন মণিপুরের রাজকন্যা। রাজপরিবারে বিবাদের কারণে প্রবীণ রাজকর্মচারী কৈলাসচন্দ্র সিংহের পরামর্শে নবদ্বীপ চন্দ্র কুমিল্লায় এসে বসবাস করতে শুরু করেন। এসডি বর্মণের শৈশব-কৈশোর কাটে এ কুমিল্লায়। তাঁর বাবা নবদ্বীপ চন্দ্রও ছিলেন একজন সুগায়ক ও দক্ষ সেতারবাদক। ধ্রুপদী সঙ্গীতেও তাঁর দক্ষতা ও চর্চা ছিল। বাবার কাছেই প্রথম সঙ্গীতের তালিম নেন এসডি বর্মণ। এরপর তিনি ওস্তাদ বাদল খান, ওস্তাদ বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন।
এসডি বর্মণ একজন প্রবাদ প্রতিম ভারতীয় বাঙালি কণ্ঠশিল্পী ও চলচ্চিত্র সুরকার, যার বাংলা ও হিন্দি উভয় ভাষার চলচ্চিত্রে সুর করা গানগুলো জাদুর মতো এখনও দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে আলোড়ন তুলছে। তিনি শৈশব থেকেই লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বহু লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেন এবং রাগসঙ্গীতের সংমিশ্রণে সুরারোপ করে নতুন সুরজাল সৃষ্টি করেন। তাঁর স্ত্রী তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্তের নাতনি মীরা দেবীও ছিলেন সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ও সফল ব্যক্তিত্ব। তাঁদের একমাত্র সন্তান রাহুল দেববর্মণও মুম্বাই চিত্রজগতে সুরারোপের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছিলেন। তিনিও সংক্ষেপে আর ডি বর্মণ নামে পরিচিত। আরেক বিখ্যাত শিল্পী আশা ভোঁসলে শচীনকর্তার পুত্রবধূ।
শচীনকর্তা কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ১৯২০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২২ সালে আইএ, ১৯২৪ সালে বিএ পাশের পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও গান নিয়ে অতি ব্যস্ত হওয়ার কারণে লেখাপড়ায় আর আগাতে পারেননি। এরপর কিছুদিন ত্রিপুরা রাজ দরবারে চাকরি করেন। পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, কানাকৃষ্ণ, আফতাবউদ্দিন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ ও আবদুল করিম খাঁর মতো বিখ্যাত ওস্তাদদের কাছে রাগসঙ্গীতসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে তালিম নেন।
কুমিল্লায় থাকাকালীন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও তাঁর পারিবারিক সখ্যতা গড়ে ওঠেছিল। ১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে শচীনকর্তা প্রথম গান পরিবেশন করেন এবং হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয়। এ রেকর্ডের একপিঠে ছিল ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’ আর অন্যপিঠে ছিল ‘ডাকলে কোকিল কোন বিহনে’ নামের লোকগীতি। এরপর তাঁর নজরুল গীতি এবং বহু সংখ্যক বাংলা ও হিন্দী গানের রেকর্ড বের হয়। এরমধ্যে ‘যদি দখিনা পবন’ (রাগপ্রধান), ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ (কাব্যগীতি), ‘বধুগো এই মধুমাস’ এবং ‘ওরে সুজন নাইয়া’ (পল্লীগীতি) উল্লেখযোগ্য।
১৯৩০ এর দশকে তিনি একজন গায়ক হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন সুরকারের সুরে আর সঙ্গীত পরিচালকের পরিচালনায় এসময় মোট ১৩১টি বাংলা গান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মিলনে গান গেয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৩৪ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘সেলিমা’ এবং ১৯৩৫ সালে ধীরেন গাঙ্গুলি পরিচালিত ‘বিদ্রোহী’ চলচ্চিত্রে গায়ক চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এরমধ্যে রাজ্ঞী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গীনী, মাটির ঘর উল্লেখযোগ্য। এসময় ক্রমে টালিউড থেকে বলিউড সর্বত্র তিনি গানের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন।
তিনি ১৯৪৪ সালে মুম্বাইতে চলে যান। বহুমুখী প্রতিভাধর শচীনকর্তার সুরে গান গেয়েছেন কিশোরকুমার, মুহাম্মদ রফি, মান্না দে, তালাত মাহমুদ, লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, গীতা দত্তের মতো স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ গায়ক-গায়িকারা। ১৪টি হিন্দি চলচ্চিত্র এবং ১৩টি বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি নিজেই প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। মাত্র তিরিশ বছরের সঙ্গীতজীবনে বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে প্রায় নব্বইটি চলচ্চিত্রের গানে সুর দিয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে শিকারী, দেবদাস, সুজাতা, বন্দিনী, গাইড, আরাধনা, বাজি, শবনম, দো ভাই প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
শচীনকর্তা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে উচ্চ পদ অলঙ্কৃত করেন এবং বহু সংগঠন কর্তৃক সম্মানীত হন। ১৯৫৮ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি ও এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি (লন্ডন) এবং ১৯৬৩ সালে ত্রিপুরা ললিতকলা কেন্দ্র থেকে অভিনন্দিত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং চলচ্চিত্রে হিন্দি গানের নেপথ্যে গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন।
এছাড়াও শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত সৃষ্টির জন্য ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭৩ সালে যথাক্রমে ‘তিন দেবীয়ান’, ‘গাইড’, ‘আরাধনা’ এবং ‘অভিমান’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি বিএফজেএ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৭ সালে তাঁর কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৫ টাকার একটি ডাকটিকেট প্রকাশ করেন। তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে বৃটেন, রাশিয়া, ফিনল্যান্ডসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেন। স্বীয় সঙ্গীত জীবনের বর্ণনা দিয়ে তিনি ‘সরগমের নিখাদ’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। শচীনকর্তা একজন বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদীও ছিলেন।
শচীনকর্তা সারাজীবন সঙ্গীত সাধনায় রত থেকে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাভ করেছেন অসংখ্য সম্মান ও ভালোবাসা। তবু এক মুহূর্তের জন্যও ভোলেননি নিজ জন্মভূমি বাংলা ও বাংলা মায়ের কোল। ক্ষণস্থায়ী জীবনে বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে সবার প্রিয় শচীনকর্তা ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর লক্ষ লক্ষ ভক্তকে কাঁদিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। আজ সোমবার তাঁর ৪৭তম মহাপ্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।