শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মিসাইল ম্যান--

অসাফল্যও সাফল্যের চাবিকাঠি

অসাফল্যও সাফল্যের চাবিকাঠি

বিশ্বের খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের তালিকায় বহু সাধনার বিনিময়ে স্থান নিয়েছেন বিশ্বের কাছে মিসাইল ম্যান হিসেবে পরিচিত ভারতীয় বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম। ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরমের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দরিদ্র আভুল পাকির জয়নুল আবেদীন ও গৃহবধূ অশিয়াম্মার কোল আলো করেছিলেন স্বপ্নদর্শী ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী। চার ভাই আর এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। একুশ শতকের প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোতে তাঁর অবদান উল্লেখ করার মতো।

এ পি জে আবদুল কালাম ছিলেন একাধারে বৃহত্তম ভারতের সম্মানিত রাষ্ট্রপতি, বিজ্ঞানী, লেখক, বাগ্মী, প্রকৌশলী থেকে সঙ্গীত সাধক। এতো দায়িত্বের মধ্যেও ছিলেন একজন মহান শিক্ষক এবং জনগণের কাছের বন্ধু। অল্প বয়সে ফাইটার পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে চোখের সামনে সে স্বপ্ন বিলীন হতে দেখে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। ভগ্ন হৃদয়ে চলে যান হৃষীকেশ। সেখানে দেখা পান স্বামী শিবানন্দের। স্বামীজী তাকে উপদেশ দেন, ‘আজকের ব্যর্থতা ভুলে যাও, তার বদলে তোমার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যের অনুসন্ধান করো। এয়ার ফোর্স পাইলট হওয়া তোমার নিয়তি নয়। নিজের সঙ্গে একাত্ম হও, আত্মসমর্পণ করো ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে।’

স্বামীজীর পরামর্শ শুনে এপিজে কালাম পুরো উদ্যম ফিরে পান। বারবার মনে পড়তে থাকে স্বামীজীর কথাগুলো। এরপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে তিনি ভারতের মিসাইল ম্যান হিসেবে খ্যাত হন। পোখরানে ভারতের পরমাণু শক্তি পরীক্ষার ব্লু-প্রিন্ট তাঁরই মস্তিষ্কজাত। মাত্র ৫ বছর বয়সেই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সংবাদপত্র বিক্রি শুরু করেন।

আরও পড়ুনঃ  কাঁচা বাদামের নাচে ছাত্রী-শিক্ষক

রামানাথপুরমের স্কোয়ার্টজ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে ১৯৫৪ সালে ত্রিচুরাপল্লীর সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫৫ সালে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন। লেখাপড়া শেষে ১৯৬০ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্টে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৬৯ সালে তাঁকে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় (ইসরো) স্থানান্তর করে ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণকারী যান (এসএলভি-৩) এর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। যার প্রতিদান তিনি ১৯৮০ সালের ১৮ জুলাই ‘রোহিনী’ কৃত্রিম উপগ্রহকে তার কক্ষপথে সফলতার সহিত স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ উৎক্ষেপণ ভারতকে এনে দেয় বিশ্বব্যাপি স্বীকৃতি। এতবড় মাইলফলক অর্জন সম্ভব হয় আব্দুল কালাম স্যারের হাত ধরে। এরপর ভারত সরকার বর্তমানে ভারতের তৈরি মারাত্মক পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘অগ্নি’ ও ‘পৃথ্বী’ প্রকল্পের কাজ তাঁর হাতে তুলে দেয়।

১৯৭০-১৯৯০ সালের মধ্যে আবদুল কালাম স্যার পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (পিএসএলভি) এবং এসএলভি-৩, এ প্রকল্পগুলো গড়ে তুলতে সফল হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের জুলাই থেকে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাণ্ডিত্য ও নিষ্ঠার জেরে তাঁর ওপর ২০০২ সালে ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় অর্পিত কর্মভার সম্পাদনপূর্বক ২৫ জুলাই ২০০৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন।

অবসর পরবর্তী জীবনে নিজেকে লেখালেখি ও মানবসেবায় নিয়োজিত রাখেন এবং ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট শিলং’, ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট আহমেদাবাদ’ এবং ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট ইন্দোর’র অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র প্রযুক্তিবিদ, তিরুবনন্তপুরমের আচার্য্য এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক ছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  শেষই হচ্ছে না ব্রিজের কাজ

২০১১ সালে তাঁর জীবন কাহিনির ওপর নির্ভর করে ‘আই অ্যাম কালাম’ নামক একটি বলিউড চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ২০১২ সালের মে মাসে আবদুল কালাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘হোয়াট ক্যান আই গিভ মুভমেন্ট’ নামক একটি প্রোগ্রাম চালু করেন। ২৭ জুলাই, ২০১৫ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট শিলং, মেঘালয়ের অনুষ্ঠান মঞ্চে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার অভিভাষণের মাঝেই হঠাৎ লুটিয়ে পড়েন এবং কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে চিরতরে নিভে যায় সৌরদীপ্তিসুলভ ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’-এর জীবন সূর্য। মৃত্যুকালে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে ছিল একটি বীণা, কয়েকটি পোশাক, কিছু বইপত্র এবং একটি ল্যাপটপ। একজন অকৃতদার মানুষ হিসেবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন দেশ ও দশের কল্যাণে।

বিজ্ঞানের পাশাপাশি লেখালেখিতেও তাঁর অসামান্য দক্ষতা ছিল। ছোট-বড় মিলিয়ে ১৮টি বই, ২২টি কবিতা এবং ৪টি গান লিখে গেছেন তিনি। তার মধ্যে আত্মজীবনীমূলক বই ‘উইংস অব ফায়ার’ এবং ‘ইগনাইটেড মাইন্ড’ ভারতসহ ভারতের বাইরেও খুবই জনপ্রিয়তা পেয়ে একটানা বেস্ট সেলারের তালিকায় ছিল দীর্ঘদিন।

তাঁর মহান কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৮১ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৯০ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ১৯৯৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ভারতরত্নসহ আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন এবং বিশ্বের বিখ্যাত ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট অর্জন করেন। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থী মহলে তাঁর ছিল অসামান্য জনপ্রিয়তা। তাঁর জন্মদিনকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে জাতিসংঘ ২০১০ সালে ১৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব ছাত্র দিবস’ হিসেবে পালন করে। এরপর থেকে প্রতিবছর এ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।

আরও পড়ুনঃ  যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস

ছোটবেলা থেকে পড়ে এসেছি ‘পরিশ্রমই সাফল্যের চাবিকাঠি।’ কিন্তু এ পি জে আব্দুল কালামের কর্মজীবন থেকে শিখি, ‘অসাফল্যও সাফল্যের চাবিকাঠি।’ পৃথিবীর প্রতিটি সফল মানুষ সাফল্য লাভ করেছেন অসাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে। বিশ্বের খ্যাতিমান তালিকায় উজ্জ্বল নক্ষত্র কালাম স্যারও অনেক ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একজন সফল ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী হিসেবে আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই ‘সফলতার গল্পে কেবল একটা বার্তা থাকে কিন্তু ব্যর্থতার গল্পে সফল হওয়ার উপায় থাকে’ ও ‘আমাদের কখনই হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত নয় এবং সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত যাতে কোনো বাধা আমাদের হারিয়ে দিতে না পারে,’ তাঁর এসব বিখ্যাত বাণীগুলো আমাদের উদীপ্ত করে।

সত্যিই তিনি একজন সেরা ভারতীয় এবং ভারতরত্ন। সুতরাং ড. এ পি জে আবদুল কালামের জন্মজয়ন্তীতে একজন নিখুঁত অনুপ্রেরক ও এক আদর্শ মানুষের দেখানো স্বপ্নকে বাস্তবায়নের অঙ্গীকারই হোক যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। তার ৯১তম জন্মজয়ন্তীতে শুভেচ্ছাসহ বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন