শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্য, সমাধান কোন পথে?

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। শহরের চেয়ে বেশি মানুষ যেমন গ্রামে বাস করে ঠিক তেমনি তাদের রয়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব। একদিকে রয়েছে রোগি ও রোগির স্বজনদের স্বাস্থ্য অসচেতনতা অন্যদিকে রয়েছে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর মত ঘটনা। এবং দেশে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত (ভুল চিকিৎসা?) কারণে মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কিংবা ভুল চিকিৎসার খবর আসছে। এমনকি মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়। গত এক বছর ধরে এমন মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে। যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তাঁরা বলছেন, ‘অবশ্যই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অপারেশন ও চিকিৎসা সেবায় ত্রুটি আছে এবং এর কারণ উদঘাটন করতে হবে। নইলে দেশের চিকিৎসা সেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, রোগীরা বিদেশমুখী হয়েছে, আরও বেশি হবে। কতিপয় চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও অবহেলায় রোগীর মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়।’ এদিকে ভুল চিকিৎসায় অহরহ মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত টিম গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রশ্ন হলো, অজ্ঞানকারী ওষুধের কারণ, চিকিৎসকদের গাফিলতি, নাকি অন্য কোনো কারণ তা অবশ্যই অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।

বিদ্যমান জনবল, অবকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম সবমিলিয়ে দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি চিকিৎসা সেবা যেমন চালু রয়েছে, তেমনিভাবে বেসরকারি পর্যায়ের এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মনোবৃত্তি থাকা বাধ্যতামূলক। মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করাও জরুরি। সরকারের বিদ্যমান নিয়মনীতি মেনেই স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনা করতে হবে। যদি তা মান্য করা না হয় তাহলে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক অনুমোদন দেবার কেনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করছে কিনা, আইসিইউ আছে কিনা, গাইডলাইন অনুসরণ করছে কিনা তা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি- বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। এটা হয় না বলেই ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে-সেখানে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যদি সব ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে তারা অপারেশন করতে পারবে না। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে চিকিৎসায় অবহেলা জনিত কারণে মৃত্যুর হার হ্রাস পাবে।

আরও পড়ুনঃ  পুষ্পাকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন রাশমিকা

দেশে বর্তমানে বৈধ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চেয়ে অবৈধের সংখ্যা অনেক বেশি। সারাদেশে সরকারি হাসপাতালের আশেপাশে লাখো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। যার ৯৫ ভাগ অবৈধ। যার অধিকাংশের মালিক স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা। এক শ্রেণীর ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালে ডিউটি না করে সেখানে কাজ করেন। সবমিলিয়ে সারাদেশে চিকিৎসা সেবায় চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। চিকিৎসা সেবার দুর্দশার পেছনে অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন, তেমনি জনবলের ঘাটতিও কম দায়ী নয়। প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান নেই হাসপাতালগুলোতে। মফস্বলে পদায়ন হলেও যেতে চান না অনেকে।

বাংলাদেশে প্রায়ই ভুল চিকিৎসা বা অবহেলাজনিত কারণে রোগী মৃত্যুর অভিযোগ করেন স্বজনরা। তবে এই ভুল চিকিৎসার বিষয়ে মিডিয়া ট্রায়াল না করে গণমাধ্যম কর্মী ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে, যখন তখন হাসপাতাল-ক্লিনিক ভাংচুর, চিকিৎসকদের গায়ে হাত তোলা বন্ধ করতে হবে, সভ্যদেশে এগুলো চলতে পারেনা। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৮০ এবং ৮৮ ধারাতে ‘সরল বিশ্বাসে পরিচালিত চিকিৎসাকার্যে’ সংঘটিত দুর্ঘটনার দায় থেকে চিকিৎসককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে অভিযোগ করার একমাত্র জায়গা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।

বিএমডিসির নিয়মানুযায়ী, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তা অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে জবাব দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির উত্তর অভিযোগকারীকে জানানো হবে। তিনি তা গ্রহণ না করলে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত চিকিৎসকের লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়া ‘স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩’ নামে একটি আইনের খসড়া করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে, এটি এখনো আইনে পরিণত করা হয়নি। এর খসড়াতেও চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইনে বিচার এবং আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এতে, হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানের এবং চিকিৎসা প্রদানকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে লাইসেন্স বাতিল ও চিকিৎসকের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশের কথা উল্লেখ আছে খসড়ায় এবং একইসাথে এ সকল অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ঈসা নবীর জন্মদিন এবং কিছু কথা

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে চারভাবে চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ফৌজদারি দায়বদ্ধতার অধীনে অবহেলা, দেওয়ানি দায়বদ্ধতার অধীনে অবহেলা, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ভোক্তা সুরক্ষা আইনের অধীনে অবহেলা।

ভারতের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একইসাথে আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য যথাযথ সিভিল কোর্টে যাওয়ার বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিভিন্ন ধারায় ভুক্তভোগীকে এক কোটি থেকে দশ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের মতোই ভারতে ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল’ রয়েছে যারা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। চিকিৎসকদের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারে এই প্রতিষ্ঠান।

যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করে ‘জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল’ এবং হাসপাতালগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘কেয়ার কোয়ালিটি কমিশন।’ দেশটিতে চিকিৎসায় অবহেলা হলে কঠোর আইনের বিধান রয়েছে। এটি ‘মেডিকেল ম্যানস্লটার ল’ নামেই বেশি পরিচিত। আইনটি অনেক পুরনো হলেও ২০১৮ সালে এটি সেদেশের পার্লামেন্ট রিভিউ করে। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন কমিটি তদন্ত করে বড় ধরনের কোনো ভুল বা অবহেলা হয়েছে কিনা। এটি প্রমাণিত হলে লাইসেন্স বাতিল এবং দুই থেকে দশ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর হার কমাতে এবং শতভাগ সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দেশের প্রতিটি হাসপাতালে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা, চিকিৎসকদের সব সুবিধা নিশ্চিত করে রোগীদের যথাযথ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা। তবে আশার কথা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালায়ের মাননীয় মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন মহোদয় বলেন, ‘সারাদেশে স্বাস্থ্যের কোথায় কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করবো। ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে যা যা করার করবো। অপচিকিৎসার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরও পড়ুনঃ  জেলা গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে নেই গবেষণা

স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা ফিরে আসুক, নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হোক, চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুহার হ্রাস পাক-এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (নেফ্রোলজি), চিকিৎসক নেতা,স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক ও আলোচক।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন