শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নতুন বছরে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুভ হোক

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল অংশীজনই ক্ষমতার অংশীদার। গণতন্ত্র হলো এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ ব্যবস্থায় প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার থাকে। এ ব্যবস্থায় একাধিক রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ থাকে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। এর মাধ্যমে জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও সার্বিক কল্যাণ ব্যবস্থা নিহিত থাকে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, অন্যায়ভাবে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ। ইপিআর এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জাতির পিতার বার্তাটি ছিল, ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহবান জানাইতেছি, যে যেখানে আছো, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাড়াঁও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’ এরপর দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের চুড়ান্ত অভ্যুদয় ঘটে।

স্বাধীনতা উত্তর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটি সময় কেটেছে অগণতান্ত্রিক সেনা শাসনের অধীনে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠন করে। পাকিস্তানি অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই গণতন্ত্র লাভ করেছিল। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসবের মধ্যে রয়েছে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন, স্বাধীনতার দশ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন (১৯৭২), নতুন রাষ্ট্র হিসেবে ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি আদায়ে জাতিসংঘ ও ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনের সদস্যপদ প্রাপ্তি এবং নতুন সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুনঃ  শিশুদের মোবাইল আসক্তি মানসিক বিকাশের বাধা

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট দেশি-বিদেশী স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের ষড়যন্ত্রে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। একই সালের ৩রা নভেম্বর জাতীয় চার নেতা, নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। গণতন্ত্রকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে। এ অগণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত থাকে নব্বই এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এসবের মধ্যে বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংসদকে শক্তিশালী করা, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রবর্তন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন, ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পথ উন্মোচন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বি.এন.পি-জামায়াত সমর্থিত চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। এ সময় দলীয় স্বার্থে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ২ বছর বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করে, পছন্দের লোককে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের নীলনকশা প্রণীত হয়। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বির্তকিত হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর ফলে দেশে চরম সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটে। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা-সমর্থিত সরকার দুই বছর ক্ষমতাসীন থাকে। এ সময়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রধান নেত্রীদ্বয়ের গ্রেফতার, তাঁদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সংস্কার আনয়নের উদ্যোগ, একের পর এক অধ্যাদেশ জারি ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা স্থায়ীকরণের অপপ্রয়াস চলে। দুই বছর পর এ সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ২৯ শে ডিসেম্বর ২০০৮ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৫ ই জানুয়ারি ২০১৪ এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত দুটো নির্বাচনে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক চর্চার কারণে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে।

আরও পড়ুনঃ  ১৫ই আগষ্ট! বাঙালি জাতির ললাটে কলো টিকা একে দেওয়ার দিন

৩০ জুন ২০১১ মহান জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বিদ্যমান ৪৫-এর স্থলে ৫০ করা হয়। এমতাবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের কোন সুযোগ নাই।

আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ‘অতীতের মতো এবারও জনগণের পছন্দের দল দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পাবে, এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’র প্রতীক, স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক নৌকা। সরকারের যোগ্য নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে দেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন কর্মকান্ড সাধিত হয়েছে এবং অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলে, ইনশাল¬াহ ২০২৬ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে পাব। দেখতে পাবো স্মার্ট ইকোনোমি, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট সিটিজেন, স্মাার্ট সরকার তথা স্মার্ট বাংলাদেশ। গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার ও উপ-নির্বাচনে জনগণ যেভাবে ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোট দিয়েছেন, তেমনিভাবে আগামী ৭ জানুয়ারিও ২০২৪ তারিখেও একটি উৎসবমুখর পরিবেশে জনগণভোট দেবে। সে ভোটে তারা তাদের পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে বলে আমি আশা করি।
‘আসুন, আমরা বিভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে শান্তি উন্নয়ন গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। দেশ গড়ার এই সংগ্রামে জনগণের জয়-বাংলাদেশের জয় অনিবার্য।’ এই নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজ থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের চির অবসান ঘটবে। গড়ে উঠবে একটি সহিষ্ণু ও উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গঠিত হবে দুর্নীতিমুক্ত শান্তিময় সমাজ। যার নেতৃত্ব দিবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ সমাজ।

আরও পড়ুনঃ  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম ও কোভিড-১৯

এবারের নির্বাচনে প্রায় ৩০ লাখ তরুণ ভোটার প্রথমবারের মতো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী, দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এ তরুণ ভোটারদের প্রতি রইলো আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। পরিপূর্ণ আস্থার সঙ্গে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ অতীতের অন্ধকার পেছনে ফেলে এখন আলোকিত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন আলোর পথের যাত্রী, উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথের যাত্রী। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকুক-কায়মনো বাক্যে মহান আল্লাহর নিকট আমার এই প্রার্থনা।

জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।


লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সাবেক উপাচার্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন