এম এ হাসান
একটি জাতির বিবেক হলো তার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা মানে হলো জাতির বিবেক ঘুমিয়ে থাকা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যান্য দিকগুলো এড়িয়ে যাওয়া। যা তথ্য ও প্রযুক্তির এই যুগে এসে কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দিন বন্ধ থাকলে শিক্ষার মান অনেক কমে যেতে পারে যার প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় জীবনে।
রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে পারে দক্ষ মানব শক্তি তৈরীতে। এখন প্রশ্ন হলো, প্রযুক্তির এই স্রোত ধারায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে কর্তৃপক্ষের করণীয় কি হতে পারে? তার এক মাত্র সমাধান হলো অনলাইনের পাঠদান যা ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিটি দেশে সব সময়ই করে থাকে। অনলাইনে জ্ঞান অর্জন বরঞ্চ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আজ বলবো আমার নিজের অভিজ্ঞাতার আলোকে। এবার আসুন কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা যেতে পারে। প্রথমত,আমরা সবাই জানি যে গুগল প্লে স্টোরে অনেক গুলো ভিডিও কনফারেন্স অ্যাপস রয়েছে, যেখানে প্রায় একশত জন বা তার অধিক শিক্ষার্থী একই সাথে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারে। রুটিন অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ে সম্মানিত শিক্ষকগণ অনলাইন ক্লাসে আসতে পারেন, সকল ছাত্র ছাত্রীরা একই সময়ে ভিডিও কনফারেন্সে ক্লাসে যোগ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সম্মানিত শিক্ষকদের লেকচার শোনার মনযোগ বাড়াতে পারে বলে আমার মনে হয় । যেহেতু প্রায় শিক্ষার্থী হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে সেহেতু ক্লাসে অংশগ্রহণের সংখ্যাও হতে পারে বেশি।
হ্যাঁ, অনেকে বলবে, তাহলে প্রয়োজনীয় বই পাবে কোথায়? একেবারে সহজ উত্তর, সম্মানীত শিক্ষকগণ ওনাদের লেকচার ও বই ই-বুকের মতো করে বা ফাইল আকারে সকল শিক্ষার্থীদের মেইল করে দিতে পারে বা নির্দিষ্ট অনলাইন পোর্টালে পোস্ট করে দেবেন অথবা ফেইসবুক গ্রুপে দিয়ে দিবেন আর না হয় ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে পোষ্ট দিয়ে দিতে পারেন। তা শিক্ষার্থীরা ডাউনলোড করে পড়ে নিতে পারেন । একেবারে সহজ উপায়। ইউরোপ ও আমেরিকাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশি ভাগ শিক্ষা উপকরণ ও সহায়ক বই অনলাইনেই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বই কেনার টাকাও বেচেঁ যায় এবং সহজে ঘরে বসে সব উপকরণ পেয়ে যায়।
অনেক শিক্ষার্থী এই নিয়মের বিপক্ষে গিয়ে বলতে পারে আমরা ইন্টারনেট কিনবো! কারণ হিসাবে বলতে পারে-আর্থিক অস্বচ্ছলতা। এই ক্ষেত্রে মোবাইল কো¤পানিগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য কম মূল্যে বান্ডেল প্যাকেজ দিতে পারে। যেহেতু প্রায় শিক্ষার্থীর হাতে এনড্রয়েড সেট রয়েছে , সেহেতু কেউ এই শিক্ষার ফ্লাটফর্ম থেকে বঞ্চিত হবে বলে আমার মনে হয় না।কিন্তু স্কুল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন বিষয়।
তাদের অনেকের মোবাইল সেট নেই বা দরিদ্রতার কারণে সম্ভব নাও হতে পারে। তাদের জন্য সরকারের বিটিভির মাধ্যমে পাঠদানই যথেষ্ট বলে মনে হয় অনেকে প্রশ্নের করতে পারেন, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের তো প্রেকটিকেল ক্লাস/ল্যাব আছে এইটা কিভাবে নেয়া সম্ভব! আমি বলবো যে এখন যেহেতু মানবিক বিপর্যয় , ল্যাবে যাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু এখন থিউরিটিক্যাল বিষয়গুলো আগে শেষ করে নেয়া অথবা একেবারে দুই সেমিস্টারের থিউরিটিক্যাল বিষয়গুলো একসাথে শেষ করে নেয়াটা ভালো হতে পারে । পরের সেমিস্টারে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তখন ঐ সেমিস্টারকে শুধু ল্যাব ক্লাস বানিয়ে নিতে পারেন। এতে আমার মনে হয় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এবার আসি দ্বিতীয় ধারায়,তা হলো সেমিস্টার শেষে পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন হওয়া চাই? আমি এই ক্ষেত্রে জার্মানিতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতির কথাই বলতে পারি। খুবই সুন্দর। আমি বলবো এই করোনাময় সেমিস্টারে বিভিন্ন উপায়ে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে । প্রথমত, সম্মানীত শিক্ষকগণ
প্রতিদিন ভিডিও কনফারেন্সে ১০/১৫মিনিট করে ওনার সিলেবাসকে ভাগ করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনলাইনে একক ভাবে বা গ্রুপ করে প্রেজেন্টেশন নিতে পারেন এবং তা রেকর্ড করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের প্রেজেন্টেশনের তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে নাম্বার দিতে পারেন। তারপরে, রিসার্চ পেপার বা টার্ম পেপারের জন্য অফার করতে পারেন এবং তার উপর ভিত্তি করে নাম্বার বন্টন করে দিতে পারেন। সেই সাথে শিক্ষার্থীরা যেন প্লেজিয়ারিজমের দিকে না ঝুঁকে সেজন্য অবশ্যই তাদের সতর্ক করে দিতে পারেন। পরীক্ষা পদ্ধতিতে সিলেবাসের পাঠ্যবইয়ের উপর এমসিকিউ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে ভিডিও কনফারেন্সে একসাথে। এ ক্ষেত্রে সময় দিতে হবে খুবই কম। এই ক্ষেত্রে মোবাইল ও ল্যাপটপের ক্যামেরা যেন নড়াচড়া না করে সে বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া যেতে পারে ।
লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে সম্মানীত শিক্ষকগণ একটি নির্দিষ্ট সময়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে পারেন। কিন্তু সময় থাকবে খুব কম আর প্রশ্ন এমন ভাবে করতে হবে যাতে সরাসরি বই থেকে উত্তর পাওয়া দেয়া না যায়। শিক্ষার্থীদের যাতে নিজের অবলোকনের উপর ভিত্তি করে উত্তর দিতে হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মেধা ও বিচক্ষণতার প্রসার ঘটতে পারে । প্রশ্নের মান যেন ৩-৫ নাম্বারের বেশি না হয় সেটাও ভেবে দেখা যেতে পারে । এবং তা খুব কম সময়ের মধ্যে ছবি তুলে বা স্ক্যান করে নির্দিষ্ট পোর্টালে আপলোড দিতে পারে বা ইমেইল করে দিতে পারে নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে।
সব শেষে অনলাইনর ভাইবা নেওয়ার মাধ্যমে সেমিস্টার শেষ করতে পারেন।প্রতিটি ধাপে নিদিষ্ট নাম্বার বন্টনের মাধ্যমে। আমাদের দেশে যেহেতু পরীক্ষার ফি , প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফি দিতে হয়, সেহেতু এগুলো কিভাবে আদায় করা সম্ভব? এই ক্ষেত্রে ফি সমূহ অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নেয়া সম্ভব। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু শুধু পরীক্ষার ফি ও অন্যান্য ফি দিতে হয় সেক্ষেত্রে বিকাশ , নগদ বা অন্যান্য যত পেমেন্ট সিস্টেম আছে তা অনুসরণ করতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা- এখন যেহেতু মানুষের আয় রোজগার নাই বললে চলে সেহেতু টিউশন ফি কমানোর বিষয়ে মানবিক হওয়া যেতে পারে। সরকারী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো শিক্ষার্থীদের হাতে ই বুক ও শিক্ষাউপকরণ তুলে দেয়ার জন্য দেশের/দেশের বাইরের বিভিন্ন লাইব্রেরির সাথে চুক্তি করা যেতে পারে যেন আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন লাইন রিসোর্স পড়তে পারে। যেই সুবিধাটি জার্মানীতে আমরা নিজেরাও ভোগ করি। চাইলে অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে অনলাইনে ঘুরে আসতে পারি।
পৃথিবী প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, যা কল্পনাতীত। শুধু মাত্র কেভিড-১৯ ভাইরাসের কাছে পৃথিবী স্থিমিত হয়ে আছে। কিন্তু অন্যান্য প্রযুক্তির সহায়তায় জ্ঞানের প্রসারতার দিকটি চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।
(বি:দ্র: লেখাটি আমার একান্ত মতামত, সম্মানীত শিক্ষকগণ নিজেদের মতো করো শিক্ষাদান ও পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন) বাংলাদেশের সকল সম্মানীত শিক্ষকগণ ও শিক্ষার্থীদের জন্য শুভ কামনা। ঘরে থাকুন, নিরাপদে ও সুস্থ থাকুন। এই কামনায়।
শিক্ষার্থী পিলিপস ইউনির্ভাসিটি জার্মানি