শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বন্যার পর তিস্তায় ভাঙন

বন্যার পর তিস্তায় ভাঙন

উজানের ঢলে উত্তরের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ সব নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে চরাঞ্চলের ফসল। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। এতে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার চরাঞ্চলে বিভিন্ন মৌসুমি ফসল যেমন তলিয়ে যাচ্ছে, তেমনি ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে ফসলি জমি আর ঘরবাড়ি। চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নদ-নদীর অববাহিকা এলাকার অসংখ্য চাষিসহ সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে পানি বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে তিস্তায়।

গত ৫ দিনেই তিস্তা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ১৪ একর আবাদি জমি। অথচ তিস্তা তীব্র ভাঙন ঠেকানোর কোনো প্রকার উদ্যোগ নেই। স্থানীয় প্রশাসনসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও প্রতিকার মিলছেনা বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

পাউবোর সূত্র বলছে, জেলার নদ-নদীর পানি বাড়লেও এখনও বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। গতকাল রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৪৫ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলেও রবিবার সকালে তা কাউনিয়া পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। নদীর চরিত্র অনুযায়ী পানি কমার সময়ই তীব্র ভাঙন শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে কুড়িগ্রামের রাজারহাট, লালমনিরহাটের আদিতমারি, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা চিরচেনা রুদ্র রূপে আবির্ভুত হয়েছে। গত বছরে থেমে যাওয়া ভাঙনস্থলে আবারও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে এ নদী।

সূত্রমতে, পানি বেড়ে যাওয়ায় গত এক সপ্তাহে রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের রামহরি মৌজা, ২নং ওয়ার্ডের চতুরা মৌজাসহ তৈয়ব খাঁ, মানাবাড়ি ও তিস্তার মধ্যচরে চাষ করা ধান, পেঁয়াজ ও বাদামসহ বিভিন্ন ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এই ইউপির চতুরা মৌজায় পাউবোর তীর রক্ষা প্রকল্পের শত শত জিও ব্যাগ দেবে গিয়ে ভাঙন ঝুঁকিতে ফেলেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। তিস্তার ভাঙনে গত এক সপ্তাহে ওই উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের গতিয়াশাম সরিষাবাড়ী ও ৮ নং ওয়ার্ডের খিতাব খাঁ বড় দরগা এলাকায় কয়েক একর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  করোনায় চীনের ভূমিকা জানতে তদন্ত চায় ১০০ দেশ

ভাঙনের তীব্রতায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। ভাঙনের ঝুঁকিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের বসতঘর ও শত শত হেক্টর আবাদি জমি। ইতোমধ্যেই ভাঙনের মুখে পড়েছে লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার মহিষখোচা, হাতিবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারি, সির্ন্দুনা, ডাউয়াবাড়ি, সদরের গোকুন্ডা, কালমাটি, রংপুরের নোহালি, কোলকোন্দ, গাবুড়াসহ বেশ কিছু এলাকা।

তিস্তায় পানি বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের ফসলের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি ভাঙন তীব্র হওয়ায় হুমকিতে পড়েছে উঠতি ফসলি জমি আর ঘরবাড়ি। ভুক্তভোগী চাষিরা বলছেন, বিশেষ করে পেঁয়াজ-রসুনসহ মৌসুমি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নদী থেকে মাত্র ১০ গজ দূরত্বে বিলীনের অপেক্ষায় ঘড়িয়ালডাঙা ইউপির গতিয়াশাম কমিউনিটি ক্লিনিক এবং মাত্র ৫০/৬০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে নামাভরট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষায় পাউবোর ফেলা জিও ব্যাগ দেবে যাওয়ায় যেকোনও সময় প্রতিষ্ঠান দুটি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার শঙ্কা জেগেছে। এছাড়া আশপাশের এলাকায় আরও বেশ কিছু স্থানে পাউবোর ফেলা জিও ব্যাগ দেবে গিয়ে ভাঙন ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

গতিয়াশাম এলাকার বাসিন্দা মোস্তাক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, গত কয়েকদিনের ভাঙনে বেশ কিছু পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। আবাদি জমি বিলীন হয়েছে কয়েক একর। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মৃত মোখলেছুর রহমান ও সাবেক ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলামের বাড়ি যেকোনও সময় নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে। তাদের পরিবারের লোকজন ঘর ও আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভাঙন প্রতিরোধ করতে না পারলে এবারও শত শত পরিবার বাস্তুহারা হয়ে পড়বে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিস্তা পাড়ের এই বাসিন্দা।

আরও পড়ুনঃ  মসজিদে বিস্ফোরণ : স্থগিত থাকছে দগ্ধদের ক্ষতিপূরণের আদেশ

ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস প্রামাণিক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘গত বছর তিস্তার তীব্র ভাঙনে শত শত পরিবার ভিটেহারা হয়েছে। আমার ইউনিয়নের ৫ ও ৮নং ওয়ার্ডের প্রায় অর্ধেক অংশ নদীগর্ভে চলে গেছে। মানুষ ঘরবাড়ি আর আবাদি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পাউবো কারও কাছে কোনও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এ বছরও একই জায়গায় ভাঙছে। পাউবোকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার মিলছে না। আব্দুল কুদ্দুস প্রামাণিক আরও বলেন, ‘শুকনো মৌসুম গেলো, তখন পাউবো কোনও কাজ করলো না। এখন স্রোতের সময় তারা কী কাজ করবে! মানুষের হাহাকার দেখা দায়। ভাঙন রোধ করতে না পারলে হাজারও মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাবে।’

লালমনিরহাটের মহিষখোচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ভাঙতে ভাঙতে এই ইউনিয়নটা শেষই হয়ে গেল। আমি ১৫ বছর ধরে চেয়ারম্যান। কত যে চিঠি লিখেছি। কাজের কাজ কিছুই হয় না। সামান্য জিও ব্যাগ দিয়ে তো আর ভাঙনরোধ সম্ভব নয়। তাই আমি নিরূপায়।

পাউবো কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘তিস্তার ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। অনুমোদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বারবার যোগাযোগ করেও প্রতিকার মিলছে না- ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রকৌশলী বলেন, গত বছর ভাঙনের পরই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বরাদ্দ চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। শুকনো মৌসুমে আমরা অনুমোদন পাইনি। অনুমোদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনও কোনও স্থানে জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা দেখার জন্য আমরা পরিদর্শনে যাচ্ছি।’

আরও পড়ুনঃ  কুমিল্লা মুরাদনগরে যানজট নিরসনে উচ্ছেদ অভিযান

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন