শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাদকে অশান্ত তিস্তার চর

  •   মাদকদ্রব্য আনা-নেওয়ার নিরাপদ রুট এখন তিস্তার চর
  •   করোনাকালেও রংপুরে চলছে রমরমা বাণিজ্য

অভিযান অব্যাহত থাকার পরও রংপুরে বন্ধ হয়নি মাদক ব্যবসা। করোনাকালেও কমেনি এর বিস্তার। করোনা সংক্রমণরোধে প্রশাসন যখন ব্যস্ত তখন মাদক কারবারিরা তাদের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারত সীমান্ত থেকে মাদকদ্রব্য আনা-নেওয়ার নিরাপদ রুট হিসেবে তিস্তার চরাঞ্চলকে ব্যবহার করায় রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা আশঙ্কাজনক ছড়িয়ে পড়ছে।

রংপুর নগরীর বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়ে গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে ৩০ বোতল ফেনসিডিলসহ সেলিম মিয়া (২৭) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সেলিম লালমনিরহাট জেলার আদিতমারীর আব্দুর রশিদের ছেলে। অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) সাজ্জাদ হোসেন জানান, বেশ কিছুদিন ধরে সীমান্ত এলাকা থেকে তিস্তার চর পেরিয়ে মাদক আসছে। প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মাদকবহন করে মেডিকেল এলাকাসহ রংপুরের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে আসছে একটি চক্র। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এমন খবর পেয়ে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকমোড়ে অভিযান চালিয়ে ৩০ বোতল ফেনসিডিলসহ সেলিমকে গ্রেপ্তার করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রংপুরের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ইতিমধ্যে চিহ্নিত অনেক মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা করার পর সেটা যাচাই করেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী এখনও বাইরে আছে উল্লেখ করে তারা বলেন, অভিযানের ভয়ে তারা ব্যবসার কৌশল কিছুটা পরিবর্তন করেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, অভিযানে ফেনসিডিলের বোতলসহ দু’চারজন ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ফিরে এসে আবারও তারা জড়িয়ে পড়ছে পুরানো ব্যবসায়। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি অবহেলিত ইউনিয়নের নাম গজঘণ্টা। দীর্ঘদিন এ ইউনিয়নটি ‘ফেনসিডিলের আড়ৎ’ হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফেনসিডিলের পাশাপাশি মদ, গাঁজা, তাড়ি, ভাং ইত্যাদি মাদকদ্রব্য খোলামেলা বিক্রি হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে পরিচিতি পেয়েছে নেশার রাজ্য হিসেবে। বহিরাগত খদ্দেরের পাশাপাশি স্থানীয় যুবকরাও নেশাগ্রস্ত হওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে অভিভাবকরা। তিস্তার চর পেরিয়ে মূলত রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এসব মাদকদ্রব্য।

আরও পড়ুনঃ  গনভূঞা জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার সচেতনতায় ক্যাম্পেইন

অনুসন্ধানে জানা যায়, কিছুদিন আগেও শুধু গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা বাজারই ছিল ফেনসিডিল কেনা-বেচার নির্দিষ্ট স্থান। বর্তমানে তা উক্ত ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকাসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। গজঘণ্টা বাজার ছাড়াও পার্শ্ববর্তী মানাস নদীর ব্রিজের নিচে, হাবু পাঁচমাথা, কিশামত হাবু শ্মশানপাড়া, রাজবল্লভ বাঁধের ওপর, ছালাপাক চর, কৈপাড়া, কাস্টমবাজার, কাগজীপাড়া ও উমর গ্রামে অবাধে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হচ্ছে। এছাড়া হারাগাছ সীমানার স্লুইচগেট থেকে জমচওড়া’র পাশ হয়ে মহিপুর পর্যন্ত তিস্তা বাঁধের বিভিন্ন স্থানসহ চরগ্রাম ছালাপাক, জয়রামওঝা, কোলকোন্দ ইউনিয়নের কুড়িবিশ্বা এবং গঙ্গাচড়া উপজেলা সদরে জমজমাট মাদক ব্যবসা চলছে। পাশাপাশি রাতদিন নেশার আসরও বসানো হচ্ছে ওইসব এলাকায়।

রংপুর শহর থেকে প্রভাবশালী বখাটে ও সন্ত্রাসী যুবকরা খদ্দের হিসেবে আসে এসব পয়েন্টে। প্রতিদিন শহর থেকে আসা নেশাখোরদের রিকশা-মোটরসাইকেলে ভরে যায় গজঘণ্টা বাজারসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা। বিশেষ করে শুক্রবার ছুটির দিনসহ বিশেষ দিনে অনেকে আসে কার-মাইক্রোবাস নিয়ে। এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, কালেভদ্রে পুলিশ অভিযান চালিয়ে লোক দেখানো তিন-চার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করলেও ব্যবসায়ীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গজঘণ্টা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বলেন, মাদকদ্রব্য পরিবহনের সময় অনেকে গ্রেপ্তার হয়। কয়েকদিন পর ছাড়া পেয়ে আবারো তারা ওই কাজ শুরু করায় মাদকের ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না।

গঙ্গাচড়া থানা সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর র‌্যাবের গুলিতে গঙ্গাচড়া ও লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সীমান্তবর্তী চন্ডিপুর নামক চরে র‌্যাবের সাথে গোলাগুলিতে মাদক ব্যবসায়ী আলেক ফ্যাক্টরী নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয় তার সহযোগী আব্দুল হক। এসময় র‌্যাব ঘটনাস্থল থেকে ৯৮ বোতল ফেনসিডিল ও একটি দেশীয় শর্টগান উদ্ধার করে। এরপরও ওই রুটে মাদক ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুনঃ  ঈদে লঞ্চের টিকিট কাটার নতুন নিয়ম

গঙ্গাচড়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্য সুশান্ত কুমার সরকার জানান, বিভিন্ন এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা স্ব স্ব এলাকায় মাদকদ্রব্য আনা-নেওয়ার সিন্ডিকেট গড়ে তোলায় মুল ব্যবসায়ীরা খুব কম ধরা পড়ে। তবে মাদকবিরোধী অভিযানে ব্যবসা অনেকটা কমে এসেছে। পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাটের সীমান্ত দিয়ে মাদকদ্রব্য আনা-নেওয়ার নিরাপদ রুট হিসেবে তিস্তার চরাঞ্চলকে ব্যবহার করায় কৌশল অবলম্বন করে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন