রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বন্ধের পথে নোয়াখালীর একমাত্র তাঁতশিল্প

বন্ধের পথে নোয়াখালীর একমাত্র তাঁতশিল্প

২০০৩ সালে ৭০জন নারী শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কর্মরত ১৭। ২৬ মেশিনের মধ্যে বন্ধ ২০টি। করোনাকালীন সময়ে ২০১৯ সালে বিক্রি ছিলো প্রায় সাড়ে ১৬লাখ, ২০২০ সালে যা কমে মাত্র সোয়া ৫ লাখ টাকা। শ্রমিকদের বেতন ও বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতিমাসে প্রতিষ্ঠানটিতে খরচ দেড় লাখ

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বর্জন করা হয় তাদের তৈরি পোষাক। এর অংশ হিসেবে তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে হস্তচালিত কাঠের তৈরি চরকা দিয়ে শুরু হয় তাঁতশিল্পের। তাঁতীরা তাঁতে কাপড় বুনতেন। এসব তাঁতে তৈরি হতো লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা ও ধুতিসহ বিভিন্ন পোষাক। যা গ্রামীণ জনপদের মানুষের পোশাকের চাহিদা পূরণ করতো।

১৯২১ সালে ভিনদেশি তৈরি কাপড় বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগে আসেন তিনি। সেখানকার তৎকালীন জমিদার ব্যরিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ তার সকল সম্পত্তি গান্ধীজির আর্দশ প্রচার এবং গান্ধীজির স্মৃতি সংরক্ষণের একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে জন্য দান করেন, প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি ট্রাস্ট। ট্রাস্টটির নামকরণ করা হয় কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট হিসেবে। ১৯৭৫ সালে তার নাম পরিবর্তন করে করা হয় গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট। ২০০৩ সালে গান্ধী আশ্রমে চালু করা হয় একটি তাঁতশিল্প।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছর ওই তাঁতে তৈরি প্রায় অর্ধকোটি টাকার কাপড় বিক্রি হতো। তবে ২০১৯ সালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে কমতে থাকে উৎপাদন। করোনা ভাইরাসের কারণে বিক্রি কমে যাওয়া, পাইকার না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধের পথে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ, প্রতিমাসে গুনতে হচ্ছে লোকসান। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এ শিল্পটি আবার তার পুরনোদিন ফিরে পাবে এমনটা প্রত্যশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুনঃ  দেশে করোনায় আক্রান্ত প্রথম মৃত ব্যক্তির দাফন সম্পন্ন

২০০৩ সালে প্রথমে ১০জন নারী শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে তাঁতটি। পরবর্তীতে ২৬টি হস্তচালিত মেশিনে কর্মসংস্থান হয় ৭০জন নারীর। মজুরি ভিত্তিতে তাঁতটিতে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের আশপাশের ৭০টি পরিবারের নারী সদস্যদের কর্মসংস্থান হওয়ায় তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হতে শুরু করে। এর বাইরে বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় একজন ম্যানেজারসহ আরও ৯জন। দিনপ্রতি পণ্য তৈরির ওপর মজুরি দেওয়া হতো শ্রমিকদের, দুপুরে খাওয়া বাবদ দেওয়া হতো ৫০টাকা করে। এখানে তৈরি পাঞ্জাবি, কটি, শাড়ী, শাল, ওড়না, থ্রী-পিস, টু-পিস, পতুয়া, উত্তোরিও, কাপড়ের পঞ্জিকা, কবি ব্যাগ, গামছা, শিশুদের পোষাক, তোয়ালে, বেডসিট, রুমাল, মাস্ক, থান কাপড় এলাকার চাহিদা পূরণ করে পাইকার ও এজেন্টের মাধ্যমে সারাদেশের বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করা হতো। চলতি বছরের শুরু থেকে কয়েকটি অনলাইন বিক্রেতার মাধ্যমে পণ্য বিক্রি শুরু করা হয়েছে।

২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনার প্রভাব পড়ে এ তাঁতে। লকডাউনসহ বিভিন্নবিধি নিষেধে কমতে থাকে বাহির থেকে আসা পাইকার। করোনা সংকটে পড়ে প্রতিদিনই কমতে থাকে বিক্রি। বিক্রি কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমে যায়। এতে ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় মাত্র ১৭জন শ্রমিক রেখে ৫৩জনকে ছাটাই করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের ২০টি তাঁত মেশিন।

আরও জানা যায়, ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠানের ২৬টি তাঁত থেকে তৈরি হওয়া প্রায় অর্ধকোটি টাকার পণ্য দেশেরা বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে বিক্রি করা হতো। তাঁতের নিজস্ব বিক্রি কেন্দ্রের বাইরে প্রায় প্রতিটি জেলায় পাইকারের মাধ্যমে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হতো। গত ৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে বিক্রি কমেছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। যেখানে ২০১৫ সালে বিক্রি ছিল অর্ধকোটি টাকা। যা ২০২০ সালে নেমে আসে সোয়া ৬ লাখ ১০ হাজার টাকায়, ২০২১ সালে ছিল ৬ লাখ টাকা, যা করোনার শুরুতে ২০১৯ এ ছিল সাড়ে ১৬ লাখ টাকা।
তাঁতের চরকা শ্রমিক রুমা আক্তার বলেন, চরকার মাধ্যমে বোভিন, চানা কাটা, তুলা কাটার ও সুতা রংয়ের কাজ করেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  এখন থেকে ওদের পরিচয় পাবেন পোষাকে

গত ১০ বছর ধরে এক কাজের বাইরে আর কিছু তার জানা নেই, বর্তমানে তাঁতটির যে অবস্থা যে কোন মুহুর্ত্বে সেটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর তাতে চাকরি হারিয়ে ফেললে আর কোথাও কাজ পাওয়ার সম্ভবনা নেই তার।

পারভিন লাকী নামের একজন ক্রেতা জানান, তিনিসহ তার দুইজন সহকর্মী ঢাকা থেকে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের জাদুঘরে ঘুরতে এসেছেন। এখানে তাঁতে কাপড় তৈরি হয় বিষয়টি জানতে পেরে আশ্রমের খুচরা বিক্রি কেন্দ্রে থেকে একটি পাঞ্জাবি, একটি কটি ও তিনটি শাল ক্রয় করেছেন। হস্তচালিত তাতে তৈরি হওয়া পণ্যগুলোর গুণগত মান অনেক ভালো বলে জানান এ ক্রেতা।

সোনাইমুড়ী বাজারে কাপড় ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, বাজারে তাঁতে তৈরি পণ্যের চাহিদা প্রচুর ছিলো, গুণগতমান ভালো হওয়ায় বিশেষ করে নারীদের শাড়ি, থ্রী-পিস, টু-পিস, থানকাপড় ও শাল বিক্রি ছিলো লক্ষণীয়। প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার তাঁতের তৈরি পোষাক আমার দোকানে বিক্রি হতো। তবে হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে দোকানের অন্য মালামালের সাথে কাপড় বিক্রিও অনেক কমতে শুরু করে। মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে এমন সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করেন তিনি।

এ বিক্রেতা আরও জানান, শপিংমল ও বড় দোকানগুলোতে বিক্রি কমলেও ফুটপাতের হকারদের স্টলগুলোতে কিছু ক্রেতা দেখা যায়।

গান্ধী আশ্রম তাঁতের খুচরা বিক্রি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মিরুপা ইয়াছমিন জানান, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। এ বিক্রি কেন্দ্র থেকে প্রতি পিস পাঞ্জাবি ২৫০০টাকা, কটি ১২০০টাকা, কোট ৩০০০টাকা, শাড়ী ১৪০০টাকা, শাল ৭৫০টাকা, থ্রী-পিস ২০০০টাকা, টু-পিস ১৫০০টাকা, পতুয়া ৭০০টাকা, উত্তোরিও ৩০০টাকা, কবি ব্যাগ ৩৫০টাকা, গামছা ১৮০, বেডসিট ৯০০টাকা, তোয়ালে ২০০টাকা ধরে বিক্রি করা হয়।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, শুরু থেকে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি ছিলো তার কিছুই এখন নেই। এক করোনার কারনে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি আজ বন্ধের পথে। পাইকার না থাকায় বাজারে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  কাল জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের পরিচালক রাহা নব কুমার জানান, স্থানীয়দের আত্মনির্ভরশীলতার উদ্দেশ্যে এখানে তাঁতশিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়, কর্মসংস্থান হয় প্রায় শতাধিক নারীর। ঢাকা থেকে সুতা এনে এ তাঁতে ব্যবহার করা হয়, এছাড়াও তুলা থেকেও চরকার মাধ্যমে আমরা নিজেরা সুতা তৈরি করে থাকি। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে আমরা সফলতার সাথে আমাদের পণ্যগুলো দেশের বড় বড় বুটিং হাউজে বিক্রি হয়। প্রায় তিনশত ধরনের কালারসেট আমাদের এখানে তৈরি করা হয়। তবে করোনার কারণে বুটিং হাউজগুলোর চাহিদা না থাকায় আমাদের প্রতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধের পথে। তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারিভাবে উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

সংবাদটি শেয়ার করুন