শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রেকর্ড বৃষ্টিতে সৈয়দপুরে বন্যা পরিস্থিতি

রেকর্ড বৃষ্টিতে সৈয়দপুরে বন্যা পরিস্থিতি

চারদিনের অবিরাম বর্ষণে নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভাসহ উপজেলার সব ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল হাটুপানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। শনিবার রাত থেকে রবিবার দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় রেকর্ড ৩৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রেলওয়ে কারখানা সহ শহরের প্রায় সব পাড়া মহল্লার অলিগলি পথ, নিচু বাড়িঘর ও পুকুর ডোবায় থৈ থৈ পানি। আর গ্রামাঞ্চলের ফসলের ক্ষেত, মাছের খামার তলিয়ে যাওয়াসহ চারপাশে বর্ষার পানির ব্যাপক সমারোহ। অভাবনীয় প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সর্বস্তরের জনজীবন।

গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি শুক্রবার সকাল পর্যন্ত থেমে থেমে চললেও শনিবার রাত থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত তা তুমুল আকার ধারণ করে। দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে অলিগলি পেরিয়ে আজ শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ ডা. জিকরুল হক সড়ক, শহীদ ডা. সামসুল হক সড়ক, পৌরসভা সড়কেও হাঁটুপানি জমে একাকার। পৌর এলাকার বাঁশবাড়ী, মিস্ত্রীপাড়া, হাতিখানা, নিচু কলোনী, মুন্সিপাড়া, কয়ানিজপাড়া, গোলাহাট, নিয়ামতপুর জুম্মাপাড়া, আতিয়ার কলোনী, কাজিপাড়া, নতুন বাবুপাড়া, বাঙগালীপুর নিজপাড়াসহ প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লার রাস্তাগুলো পানির নিচে।

এসব এলাকার অনেক বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। বাজারের দোকান ও গোডাউনেও একই অবস্থা। ফলে বাসার আসবাবপত্র ও দোকানের মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হওয়ার উপক্রম। কাঁচামাল পঁচে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। এতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। একদিকে পানিবদ্ধতা, অন্যদিকে উপার্জনহীন। তার উপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ চরম সমস্যায় পড়েছেন। শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে এবং পানিবন্দি মানুষ চুলা জ্বালাতে না পেরে অনাহারে রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বৃষ্টির পানির আধিক্যের ফলে নিম্নাঞ্চলসহ অনেক উঁচু এলাকাতেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ধানের ক্ষেত, পুকুর পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও পানির স্রোতের চাপে রাস্তা ভেঙে গেছে। সবজির ক্ষেত নষ্ট হওয়া সহ পুকুর ডুবে মাছ বেরিয়ে গেছে। নিচু বাড়ি ঘরেও পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ পানিতে আবদ্ধ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। খেটে খাওয়া হতদরিদ্র দিনমজুর মানুষেরা আয় করতে না পেরে না খেয়ে আছেন। বিশেষ করে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিবাসীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

আরও পড়ুনঃ  সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসক গ্রেপ্তার

পৌরবাসীর অভিযোগ ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হওয়ায় পানি বের হতে পারছেনা। একারণে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। সেখানে এত বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষের অসচেতনা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই সৈয়দপুরের এই দূরাবস্থা। পরিকল্পিতভাবে ধারাবাহিকতার সাথে অচল ড্রেন মেরামত, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নতুন ড্রেন নির্মাণ ও নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করলে এই দুর্ভোগ পোহাতে হতোনা।

তাদের মন্তব্য হলো প্রতিবছর এমন শোচনীয় অবস্থা দেখা দিলেও নাগরিকদের কষ্ট লাঘবে জনপ্রতিনিধিদের কোন উদ্যোগ নেই। এতে কিছু কিছু এলাকায় শুকনা মৌসুমেও রাস্তায় পানি জমে থাকে। আর বৃষ্টি হলে ড্রেন উপচে পানিসহ নোংরা ময়লা আবর্জনা ঢুকে পড়ে বাসায়। জমা পানিতে মশার উৎপাদন বাড়ায় উৎপাতও বেড়েছে। এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুঃসহ যন্ত্রণায় বছরের পর বছর কাটছে এলাকাবাসীর। বাঁশবাড়ী, মুন্সীপাড়া ও হাতিখানায় দীর্ঘদিনের এমন দূর্দশায় কারো যেন মাথাব্যথা নেই।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক (ডিএসডাব্লিউ) সাদেকুর রহমান বলেন, অতিবৃষ্টিতে কারখানার কয়েকটি সপে (উপ-কারখানা) পানি জমেছে। এতে কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। সেই সাথে বিদ্যুৎ না থাকায় সপগুলো বন্ধ রয়েছে। পার্বতীপুর ক্যারেজ লোকোমেটিভ কারখানায়ও (কেলোকা) একই অবস্থা। পানি নিষ্কাশনের জন্য সৈয়দপুর পৌরসভার ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ায় এমন পানিবদ্ধতার সমস্যা বলে মন্তব্য করেন তিনি। এক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।

এবিষয়ে সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র রাফিকা আকতার জাহান বেবীর সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, বৃষ্টি প্রাকৃতিক ব্যাপার। এটা আটকানো বা হওয়ার পর পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা মানুষের হাতে নেই। শহরের ডোবা তথা জলাধারগুলো দখল ও ভরাট হওয়ায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এব্যাপারে আমরা পরিষদগতভাবে উদ্যোগ নিয়েছি। তবে জনগণের অসহযোগিতার কারণে সফল হতে পারিনি। আগামীতে এদিকটাই গুরুত্বের সাথে দেখা হবে। আর আমি বর্তমানে ঢাকায় জরুরী মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি। সৈয়দপুরে ফিরলে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করবো।

আরও পড়ুনঃ  ওরা দল বেঁধেছে একা

সৈয়দপুর রাজনৈতিক জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ আলহাজ্ব আব্দুল গফুর সরকার বলেন, নৌকার মেয়র তাঁর সরকারের মতই লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত। নিজের আখের গোছানোয় সচেষ্ট থাকলেও জনগণের ভোগান্তি লাঘবে তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। বিগত সাড়ে তিন বছরে পৌরসভার উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন কাজ করা হয়নি। ড্রেনেজের অচলাবস্থায় পানিবন্দি হওয়া সৈয়দপুরবাসীর চির দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মরহুম আমজাদ হোসেন সরকার মেয়র থাকাকালে এমন দূর্যোগের সময় শহরব্যাপী ব্যাপক সহায়তা কার্যক্রম চালানো হতো। যাতে লোকজন কষ্ট না পায়। অথচ আজকে মেয়র সৈয়দপুরেই নেই। পৌর পরিষদের অন্যান্য সদস্যরাও নির্বিকার। আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও অন্যান্য ত্রাণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।

সৈয়দপুর উপজেলা জামায়াতের আমীর হাফেজ মাওলানা আব্দুল মুনতাকিম বলেন, সারাদেশের মত সৈয়দপুর পৌরসভাতেও উন্নয়নের নামে দূর্নীতি আর অপকর্মই হয়েছে। সেকারণ জনভোগান্তি কমার পরিবর্তে বেড়েছে। ড্রেনেজ, ডাস্টবিন, যানজট, মাদকসহ নানা সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের যেহেতু এদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই, তাই এনিয়ে কথা বলেও কোন কাজ হবেনা। সেজন্য কথা না বলে কাজে নেমেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে শহর শাখার উদ্যোগে পানিবন্দি মানুষের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ শুরু করেছি। পৌরসভার ২, ৩, ৬, ১৪, ১০ নং ওয়ার্ডে আমাদের খাদ্য পৌঁছিয়েছি। অন্যান্য ওয়ার্ডে ও উপজেলা শাখার পক্ষ থেকে সব ইউনিয়নে দেয়া হবে। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সংগঠনের দিকে চেয়ে না থেকে প্রতিটি এলাকার সামর্থবান মানুষদের নিজ নিজ উদ্যোগে আশেপাশের সংকটাপন্নদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  নকল বীজে নিঃস্ব ভুট্টাচাষি

বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে কথা হয় সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিনের সাথে। তিনি বলেন, তীব্র তাপদাহের পর এটা আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তপ্ত মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে শহর ও গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে মানুষ কষ্টে পড়েছে। এমতাবস্থায় বৃষ্টি থামানোর কোনো পথ নাই।

কিন্তু সংকটাপন্ন লোকজনের জন্য সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে পানিবন্দি মানুষের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ত্রাণ প্রদানের জন্য ইউএনও এর সাথে পরামর্শক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন বা ড্রেনেজ অচলাবস্থা নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি।

এদিকে বিকাল বেলা বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় হতাশা কাটলেও আবহাওয়া বার্তা অনুযায়ী আগামী আরও দুইদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন সৈয়দপুরবাসী। সেইসাথে শহর সংলগ্ন খরখরিয়া নদীর পানি তীর ছুঁই ছুঁই হওয়ায় এবং পশ্চিম পাড়ের আবাদী জমিসহ অনেক বাড়িতে পানি ওঠায় বিগত বছরের মত পূর্ব দিকের বাধ কেটে দেওয়ার আশঙ্কায় পৌরসভার ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ নং ওয়ার্ডের লোকজন। অসহায় মানুষের মাঝে ইতোমধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন, উপজেলা জাপার সভাপতি শিল্পপতি আলহাজ্ব সিদ্দিকুল আলমের ব্যক্তিগত এবং জামায়াত ও বিএনপির পক্ষ থেকে দলীয়ভাবে শুকনো ও রান্নাকৃত খাবার বিতরণ করায় পানিবন্দি মানুষ কিছুটা রেহাই পেয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন