ভুল চিকিৎসা, প্রতারণা ও ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে রাজধানীর গ্রীন রোডে অবস্থিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. পারভেজ ইসলাম।
ওসি বলেন, বুধবার (১৪ জুন) ভুক্তভোগীর স্বামী ধানমন্ডি থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ একটি মামলা করেছে। তার মামলার প্রেক্ষিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় সন্তান হারান ইয়াকুব আলী সুমন। তার স্ত্রী মাহবুবা রহমান আঁখিও রয়েছেন মৃত্যুঝুঁকিতে।
সুমনের দাবি, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় তার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। তার স্ত্রীর অবস্থাও সংকটাপন্ন।
জানায়ায়, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান আঁখি (২৫)। নরমাল ডেলিভারির আশায় কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে রাজধানীর গ্রিনরোডে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসেন তিনি। মূলত ফেসবুকে হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক ডা. সংযুক্তা সাহার নরমাল ডেলিভারি সংক্রান্ত ভিডিও ও পরামর্শ দেখেই তার আসা। আঁখির ইচ্ছা ছিল ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে ডেলিভারি করাবেন। কিন্তু তার এই হাসপাতালে আসাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। বর্তমানে মৃত্যুশয্যায় আঁখি। আর তার সদ্যোজাত শিশুটিও মারা যায়।
আঁখির স্বজনরা জানান, হাসপাতালে আসার পর রোগীকে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনেই ভর্তি করা হয়। তবে সেসময় এই চিকিৎসক হাসপাতালে ছিলেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি তখন ছিলেন দুবাইতে। চিকিৎসক না থাকার পরও তার অধীনে রোগী ভর্তি করা হয়। এরপর ডেলিভারির চেষ্টা ও পরবর্তীতে সফল না হওয়ায় সিজার করে বাচ্চা বের করে আনা হয়। সিজারের পরদিন মারা যায় বাচ্চাটি। আর মায়ের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশেরও কম।
![](https://dainikanandabazar.com/wp-content/uploads/2023/06/353627656_929696204985154_4380183993541142963_n.jpg)
এদিকে স্ত্রীর সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে স্বামী ইয়াকুব আলি সুমনের এখন প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে আতঙ্কে। তার এখন একটাই আকুতি স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার। তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণ দিয়ে কী করবো। আমার ক্ষতিপূরণ করতে পারবে একটাই, আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুক।
সুমন বলেন, এখন পর্যন্ত আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফেরেনি। আজ পর্যন্ত কোনো উন্নতি নেই। ডাক্তার বলেছেন তার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ আমার স্ত্রীর কিডনি, লিভার, হার্ট এবং অন্য কোনো অংশ কাজ করছে না। এরমধ্যে সে ব্রেন স্ট্রোকও করেছে। রক্তক্ষরণও বন্ধ হচ্ছে না। রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় শরীরের অন্য অংশগুলো কাজ করতে ব্যর্থ। গত চারদিন ধরে প্রচুর রক্ত দিতে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিঃশ্বাস চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত রক্ত দিতে হবে।
আঁখির চাচাতো ভাই শাখাওয়াত হোসেন শামীম বলেন, ফেসবুকে ভিডিও দেখে ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে নরমাল ডেলিভারি করাতে চেয়েছিল আমার বোন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তার স্বামী। কিন্তু আমার বোনটি এখন লাইফ সাপোর্টে। তার সব অরগান ফেল করেছে। ডাক্তাররা হয়তো মৃত ঘোষণা করবেন। আর বাচ্চা তো আগেই মারা গেছে।
তিনি জানান, শুক্রবার (৯ জুন) রাতে আঁখির লেবার পেইন ওঠে। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে ডা. সংযুক্তা সাহার অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঢাকায় আনা হয় আঁখিকে। হাসপাতালে ভর্তির পর নরমাল ডেলিভারির জন্য আঁখিকে ৪০ মিনিট ব্যায়াম করানো হয়।
শামীম বলেন, আমার বোন সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। রাত ২টার পর দেখলাম হাসপাতালের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে আঁখিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অ্যানেস্থেসিয়ার ডাক্তার আসেন। এরপর আসেন প্রফেসর মিলি। তিনি সিজার করে চলে যান। যাওয়ার সময় প্রফেসর মিলি জানান, ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে নেই। তখন আমরা জানতে চাইলাম ডাক্তার নেই, তাহলে প্রথমদিকে নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করালো কে?
আঁখির চাচাতো ভাই আরও বলেন, আমার বোনের ছেলে বাচ্চা হয়েছিল। তাকে রাখা হয়েছিল এনআইসিইউতে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বুঝতে পারি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তখন আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। হাসপাতালের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো পদক্ষেপ দেখতে না পেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল দিলে ধানমন্ডি থানা থেকে পুলিশ আসে। পুলিশ এসে কথা বললে তারা রোগীকে বিএসএমএমইউ’র সিসিইউতে নিতে বলে। কিন্তু সেখানে সিট খালি না থাকায় পরদিন বিকেলে ল্যাবএইডের সিসিইউতে নেওয়া হয়।
ঘটনার বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে এ প্রতিবেদক সেন্ট্রাল হাসপাতালে গেলে পথ আগলে দাঁড়ান আনসার সদস্য। এরপর সাংবাদিক আসছে জেনে হাসপাতালের ১০৪ নম্বর রুমে থাকা সহকারী পরিচালক দ্রুত রুম ত্যাগ করেন। রিসিপশনিস্টরাও চলে যান সেখান থেকে। প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করলেও হাসপাতালের কর্তব্যরত কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে আসেননি।
আঁখির চাচাতো ভাই শামীম বলেন, আমরা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছি। কুমিল্লায় কত ভালো ভালো ডাক্তার আছে। কিন্তু আমার বোন সংযুক্তা সাহার কাছে ডেলিভারি করাতে চেয়েছিল বলে তাকে এখানে নিয়ে আসা।
আঁখির অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে ল্যাবএডের কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, ভেন্টিলেটরে থাকা অবস্থায় ওই রোগীকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে আমাদের এখানে আনা হয়। রোগীর বাঁচার আশা খুবই কম।
এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক ডা. এম এ কাশেম বলেন, এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। এরই মধ্যে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে ইউরোলজিক্যাল সার্জন মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডা. এইচ আর হারুনকে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত বলতে পারবো।
তবে কতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক।
ঘটনার বিষয়ে অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যেহেতু হাসপাতালে ছিলাম না, তাই আমার নামে এই ধরনের কাজ করে থাকলে এটা অবশ্যই অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।
তিনি বলেন, আমাকে বিশ্বাস করে সেবা নিতে বেশ কিছু রোগী আসে। এখন এই রোগীর পরিবার যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেক্ষেত্রে তারা অনেক কিছুই বলবে। এ বিষয়ে কথা বলার আগে আমাকে যাচাই-বাছাই করে বলতে হবে। আমি আমার নিজস্ব ফেসবুক পেজ থেকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম যে শনি ও রোববার আমি থাকবো না। কারণ অনেক রোগী বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার কাছে আসে। অনেক সময় না জানিয়েও চলে আসে তারা। তাই সবার সুবিধার্থেই আমি এটি আগে জানিয়ে দিয়েছিলাম।
ডা. সংযুক্তা সাহা আরও বলেন, যখন আমি কোথাও যাই বা হাসপাতালের বাইরে থাকি, তখন আমার ইমার্জেন্সি রোগীদের দেখতে দুজন অধ্যাপক থাকেন। শুক্রবার সাড়ে ১০টার দিকে আমি হাসপাতালে শেষ সিজার করে বের হই। বের হওয়ার সময় আমি কোনো নতুন রোগী ভর্তি দেখিনি। এরপর হাসপাতালের কারও সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। আমি দুবাইতে পৌঁছানোর পরও দেখতে পাইনি রোগী বা হাসপাতাল থেকে কেউ আমাকে কল দিয়েছে।
‘কাল রাতে আমি ল্যাবএইডে নিজেই দেখতে যাই ওই রোগীকে। খোঁজ-খবর নিয়ে আসি। এরপর আমি সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাই কী হয়েছিল সেদিন। তবে তারা আমার সঙ্গে আগামীকাল সময় দিতে পারবে বলে জানায়।’