শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখন আর চিঠি লিখা হয় না

এখন আর চিঠি লিখা হয় না

দিন যাওয়ার পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে যুগও। সেইসাথে আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে যাচ্ছে পুরনো অনেক রীতিও। এমন একটি পুরনো রীতি ছিল চিঠি লিখা। এক সময় পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বন্ধবসহ একে অপরের মধ্যে চিঠি ছিল যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। চিঠি চালাচালির মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। মনের মাধুরী মিশিয়ে চিঠি লিখার মজাই ছিল আলাদা।

কাগজে লিখে খামের মধ্যে দিয়ে চিঠি পাঠানো হতো। চিঠি লেখার জন্য ছিল পোস্টকার্ড ও বিভিন্ন রং-বেরঙের প্যাড। মাধুর্যতা আর মধুময়তায় ওইসব চিঠি নাড়া দিত হৃদয়ের অনুভবে। অনেকে আবার চিঠি পড়া ও লিখার জন্য পাড়ায় লোক খোঁজতেন। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ অতি সহজ হয়ে উঠায় হারিয়ে যেতে বসেছে চিঠির ব্যবহার। দাপ্তরিক কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিঠির ব্যবহার আর হয় না বললেই চলে।

দেশের অন্যান্য জায়গার মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায় একই অবস্থা রয়েছে। তবে ওই সময়টায় ডাকপিয়নেরও কদর ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি বিলি করার নানা মজার ঘটনা এখনো অনেকের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। নীল, হলুদসহ নানা রঙের খামের চিঠি আর লাল রঙের সেই ডাকবাক্স আজ যেন অনেকটাই বিলীন হওয়ার পথে। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায়, আর তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে বন্দি হয়ে আছে এক সময়ের যোগাযোগ-মাধ্যম চিঠি, ডাকপিয়ন, ডাকবাক্স আর পোস্ট অফিস। এখন আর আগের মতো কদর নেই ওই সবের। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু হওয়ায় এখন আর কেউ কাগজ-কলম নিয়ে একজন আরেকজনের কাছে চিঠি লিখতে বসে না। সেই সময় ও যেনো কারো হাতে নেই। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অতি সহজে তারা প্রিয়জনের সঙ্গে মুহূর্তেই খোঁজ খবর নিতে পারছেন।

আরও পড়ুনঃ  কাঠমিস্ত্রির ‘কমিউনিটি লাইব্রেরি’

আখাউড়া পোস্ট অফিস সূত্রে জানা যায় , এই অফিসের অধীনে ১৫টি ডাকঘর রয়েছে। দৈনিক এই অফিসে রেজি: ৬০-৬৫টি আর সাধারণ (অডিনারি) ২৫-৩০ টি চিঠি আসছে। প্রতিমাসে গড়ে ২২ শ থেকে ২৩ শ চিঠি আসছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে ডাকঘরগুলোতে ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের আদান- প্রদান অনেক যেন কমে এসেছে। শুধুমাত্র অফিসিয়াল, ব্যাংক বিমা, মামলা মোকদ্দমার ও নিয়োগপত্রের চিঠি বেশী আসছে। এদিকে সক্রিয়ভাবে চালু আছে ডাকঘরের সঞ্চয়ী ব্যাংকিং এর কার্যক্রম। এই সঞ্চয়ী কার্যক্রমে প্রতিদিন অনেক টাকার লেনদেন হয়। এই ব্যাংকিং কার্যক্রমই টিকিয়ে রেখেছে ডাক বিভাগকে। ডাক বিভাগ দেশি-বিদেশি সাধারণ চিঠি, পোস্টকার্ড, রেজিস্ট্রি চিঠি, ডাকটিকিট বিক্রয়, পোস্টাল অর্ডার, মানি অর্ডার, পার্সেল, জিএমই (গ্রান্টেড মেইল এক্সপ্রেস), ইএমএস (এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস), ভিপিপি (ভ্যালু পেবল পার্সেল) ইস্যু ও বিলি, ভিপিএল (ভ্যালু পেবল লেটার), বীমা পার্সেল, স্মারক ডাকটিকিট বিক্রয়, মোবাইল মানি অর্ডার, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, ডাক জীবনবীমা, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম জমা, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে টাকা পাঠানো ও নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রি চালু থাকলেও বেশিরভাগ সেবাই আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

সরেজমিনে আখাউড়া পোস্ট অফিস ঘুরে দেখা গেছে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র খুব একটা চোখে পড়েনি। যে সমস্ত চিঠি এসেছে তা হলো বিভিন্ন দাফতরিক বা অফিসের চিঠিপত্র। তবে সঞ্চয়ী কার্যক্রমে টাকা লেনদেনে যেন অনেক ভিড়। অন্যান্যকার্যক্রম চলছে অনেকটাই শ্লো গতিতে।

পৌর শহরের তারাগন এলাকার মো. আমান মিয়া বলেন, এক সময় আমার পাড়ার বেশীভাগ লোকজনের পড়াশুনা তেমন ছিল না। এলাকায় অনেক লোকজন প্রবাসে থাকায় বাড়িতে চিঠি আসলে তাদের চিঠি পড়া এবং লিখে দিতে হতো। আমিও মনের মাধুরি দিয়ে চিঠি লিখতাম। প্রতি মাসে পাড়ায় কম হলেও ১২-১৫ টি চিঠি লিখা ও পড়তে হতো। গত প্রায় ১০-১২ বছর ধরে কোন প্রকার চিঠি লিখা ও পড়া হয় নাই। বর্তমানে প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ করায় চিঠি লিখার প্রয়োজন পড়ছে না।

আরও পড়ুনঃ  উদ্যোক্তা মাহমুদুলের স্বপ্ন

আজমপুর এলাকার মো. আবুল হোসেন বলেন, গত ২০ বছর ধরে তার দুই ছেলে প্রবাসে রয়েছে। একটা সময় ছিল তার ছেলেরা নিয়মিত বাড়িতে চিঠি লিখতো। বাড়ির লোকজনরা অন্যের সাহায্যে চিঠি লিখত এবং চিঠি পড়া শুনতো। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মোবাইল আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে অতি সহজে যেকোন খবর সেকেন্ডের
মধ্যেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি। সেজন্য চিঠির অপেক্ষা করতে হয় না। তিনি আরও বলেন গত ১০ বছরের মধ্যে আর কোন চিঠি লিখা হয় নি।

শিক্ষার্থী মো. মনির হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর আগে চাকুরির আবেদন করতে পোস্ট অফিসে যাওয়া হতো। কিন্তু এখন বেশীভাগ ক্ষেত্রে চাকুরির আবেদনও অনলাইনে হয়ে গেছে। তাই যাওয়া হয়না।

ধরখার এলাকার গৃহিণী লিমা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী প্রায় ২০ বছর যাবৎ প্রবাসে চাকরি করেন। প্রতি বছর একবার ছুটিতে আসেন। এক সময় চিঠির জন্য অপেক্ষা করতাম তার খোঁজখবর জানার জন্য। পিয়নকে দেখলেই জিজ্ঞাসা করতাম, আমাদের চিঠি আছে নাকি? এখন মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে সরাসরি কথা বলি। চিঠির কথা প্রায় ভুলেই গেছি।

আখাউড়া ডাক অফিসের পোস্ট মাষ্টার মো. আজহার উদ্দিন আহমেদ বলেন, মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট এখন প্রত্যেককে অন্যের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে । তবে চিঠি হারিয়ে যাচ্ছে বিষয়টি সঠিক নয়। ব্যক্তিগত চিঠি কমে গেলেও ইতোমধ্যে অফিসিয়াল চিঠির পরিমাণ বেড়েছে। তবে ডাক বিভাগের নতুন নতুন সেবা মানুষের কাছে পৌছাতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করেছি। বর্তমানে সঞ্চয় পত্রে ও অন্যান্য আর্থিক কার্যাদি আমরা গুরুত্ব সহকারে সম্পাদন করছি।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন