শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তুষারের শহরে উষ্ণতা

তুষারের শহরে উষ্ণতা

প্রতিদিনের মতো সেদিনও বের হওয়া রুশ ভাষার ক্লাস করার জন্য। আবহাওয়ার পূর্বাভাস আগে থেকেই জানা ছিল। তবে কি বিস্ময় বাইরে অপেক্ষা করছে সেটা ঠিক অনুমান করতে পারিনি।

মস্কোতে তুষারের আগমনী। আর আমার প্রথম তুষারপাত দেখা। পুরো শহরটা রাতারতি যেন একটা মিউজিয়ামে বদলে গেছে। গাছগুলোকে মনে হচ্ছিল একেকটি জীবন্ত ভাস্কর্য। সুউচ্চ ভবন, সারি সারি গাড়ি, পার্ক সবটাই তুষার-আবৃত। আর পার্কগুলোর কথা আলাদা করেই বলতে হয়। সেখানে প্রকৃতি আর মানুষ একসাথে সৃষ্টির খেলায় মেতে ওঠে। শিশুরা স্নোম্যানসহ তাদের পছন্দের চরিত্র তৈরি করে। অনেকেই আবার প্রিয় পোষ্যটিকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা কুকুরছানা এতো মায়াবী চোখে তাকায়! মনে হয় কত চেনা।

সুন্দর কিছু দেখলেই কেমন এক নিঃসঙ্গতা ভর করে। এ বোধ হয় সৌন্দর্যেরই ধর্ম। সবাইকে নিয়ে উদযাপিত হতে চায়। অনেকেই প্রিয়জনকে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে মুহূর্তগুলোতে ক্যামেরাবন্দি করছিল। যেতে যেতে আবার ফিরে তাকাই। সেই তো একই শুভ্রতার সাজ। তবু প্রত্যেক স্থানের সৌন্দর্য ভিন্ন বলে মনে হয়!

সেদিন ক্লাসে আমাদের প্রিয় শিক্ষিকা যখন জানলেন এই প্রথমবার আমার তুষারপাত দেখা তিনি হাসলেন। জানালা খুলে আলতো হাতে শুভ্র তুষারকণা তুলে নিলেন। একটা স্নোবল গড়ে আমাদের দিকে ছুড়ে দিলেন। শুরু হলো শব্দের খেলা। যার কাছে বল শব্দের শেষ অক্ষর দিয়ে আরেকটা শব্দ বলতে হবে। খেলতে খেলতে আমরা যেন শৈশবের বিস্ময়ে ফিরে গেলাম- স্নেগ(তুষার)-গোরাদ(শহর)- দোম(বাড়ি)-মিত্রো(মেট্রো)…

প্রায়ই মেট্রোস্টেশনের সামনে দু-একজন শিল্পীকে দেখা যায় সামান্য পরিসরের সঙ্গীত আয়োজনে। সেদিনও গায়ে তুষার মাখিয়ে খোলা আকাশের নিচে দুজন তরুণ-তরুণী গাইছিল। সুর শুনে মনে হচ্ছিল কোন একটি প্রেমের গান। এখানে প্রেম উদযাপনের।

আরও পড়ুনঃ  নম্রতার স্বপ্ন রঙ-তুলি

মেট্রোতে ফিরে আসার সময় ‘ভারোবিওভি গোরি’ (চড়ুই পাহাড়) নামে একটি স্টেশন পড়ে যেখান থেকে বাইরের প্রকৃতি দেখা যায়। যাত্রীরা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়, কৃত্রিম সৌন্দর্যের বিস্ময় থেকে মুক্ত হয়ে কয়েকমুহূর্তের জন্য চোখদুটোকে সজীব করে নিতে। মাস্কোভা নদী আর চড়ুই পাহাড়ের সৌন্দর্য, প্রকৃতি আর সৃজনশীল সৃষ্টির অপূর্ব এক সন্ধির মতো হয়ে ধরা দেয়।

তবে রাতের তুষারপাতের সৌন্দর্য খানিকটা ভিন্ন। রাস্তায় সারি সারি কারুকার্যময় সুন্দর সব আলোক বাতি থেকে বেরিয়ে আসা হলুদ আলোয় তুষারপাত দেখলে হঠাৎ হঠাৎ দৃষ্টিভ্রম হয়। মনে হয় তারা খসে পড়ার দৃশ্য দেখছি। সন্ধ্যার পর আলোকিত মস্কো এক অন্যরূপ নেয়।

যদিও মস্কোতে ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত, ধোয়া ছড়ানো চা কিংবা কফি ছাড়া উষ্ণ হওয়া যায় না। সন্ধ্যায় কফি হাতে তুষারবিস্ময়ে তাকিয়ে কেমন নীরব হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। সময় কত দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে! মুহূর্তটা আন্তন চেখভের ‘ত্রি সিস্ত্রি’ (থ্রি সিস্টার্স) নাটকের একটা মুহূর্তের সঙ্গে কেমন মিলে যাচ্ছে- ‘কতদিন পেরিয়ে গেছে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখেছি। সবকিছু কেমন বদলে গেছে। তুষার পড়ছে, চাইলেও আমি আর বিশে ফিরতে পারবো না।’ – থ্রি সিস্টার্স। আন্তন চেখভ।

এভাবেই তুষারপাত হয়তো কখনও কখনও ভাবায় প্রকৃতির রঙবদল কেবল উপভোগের জন্যই আসেনি। এ এক সাংকেতিক বার্তাও!

শারমিন সুলতানা
মস্কো, রাশিয়া

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন