পৃথিবীর আলো দেখার আগেই হারিয়েছেন বাবা হামেদ আলীকে। পরিবারে লোক বলতে মা আলীমন বেওয়া ও তার দুই ভাই বোন ছিল। মাস দুই আগে ব্রেনস্ট্রোকে মারা গেছেন মা। চার সদস্যের সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যদিনের অতিথি। পরের বাড়িতে কাজ করে কোনভাবে চলে তাদের সংসার। এতো কষ্টের মধ্যেও থেমে থাকেনি রোজিনা। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও লেখাপড়া থেমে যায়নি শারীরিক প্রতিবন্ধী এই শিক্ষার্থীর। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক রোজিনা যেনো ছুটে চলছে সামনের দিকে।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাকশিমুইল ইউনিয়নের পরিজুন পাড়ার বাসিন্দা রোজিনা খাতুন। তিন বছর বয়সেই অপুষ্টিজনিত কারণে পোলিও রোগে আক্রান্ত হন তিনি। পুরোপুরি সুস্থ হওয়া না গেলেও কোনো চিকিৎসা না পাওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতাই ছিল অভাব। কোনো কিছুতে ভর না দিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না তার। এমতাবস্থায় হুইলচেয়ারই যেন নিত্যসঙ্গী হয়েছে তার।
রোজিনা ২০১০ সালে মোহনপুরের নাকইল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালে পঙ্গু শিশু নিকেতন সমন্বিত অবৈতনিক ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে অংশ নিয়ে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন।
টানাপোড়নের সংসারে বেড়ে ওঠা রোজিনা অব্যাহত রাখেন পড়াশোনা। শিক্ষা জীবন শেষ করে সরকারি চাকরি করে পরিবারের দু:খ ঘোচাবেন এমন স্বপ্ন নিয়ে স্নাতকে ভর্তি হন অদম্য শিক্ষার্থী রোজিনা। তিনি উপজেলার দাউকান্দি ডিগ্রী কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। চার বছরের কোর্স সম্পন্ন করে রাজশাহী কলেজে স্নাতকোত্তরে ভর্তির আবেদন করেন তিনি।
দেশসেরা বিদ্যাপীঠে ভর্তির সুযোগও পেয়েছেন এই মেধাবী শিক্ষার্থী। সেখানে স্নাতকোত্তরে লেখাপড়া করছেন রোজিনা।
রোজিনা খাতুন বলেন, আমার জন্মের আগেই বাবা মারা গেছেন। কিছুদিন আগে মাও মারা গেলেন। অভাবের সংসারে দিন পার করাই কঠিন। এরমধ্যেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। রোজিনার বিষয়ে এগিয়ে এসেছে রাজশাহী কলেজ কর্তৃপক্ষ। তারা রোজিনার ভর্তি খরচ ফ্রি করে দেন।
রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, রোজিনা খাতুন শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা। এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও সে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সে প্রতিনিয়ত সাথে সংগ্রাম করে চলছে। মাস্টার্স পরীক্ষার ফরম পূরণসহ সকল ফি কলেজ প্রশাসন বহন করবে বলেও জানান তিনি।
অধ্যক্ষ আরও বলেন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার ও কলেজ লাইব্রেরী থেকে তার সকল বইয়ের ব্যবস্থা করা হবে। যেহেতু তার ক্লাসে নিয়মিত হওয়া কষ্টসাধ্য তাই সে যেন বাসা থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারে সে ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি তার যে কোনো সমস্যায় কলেজ প্রশাসন পাশে থাকবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
রোজিনা বলেন, রাজশাহী মহানগরীর বড়কুঠি এলাকায় তিনি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। সেখানে ঘর ভাড়া লাগে এক হাজার ৭০০ টাকা। সেখান থেকেই তিনি রাজশাহী কলেজে ক্লাস করেন। মানুষের সহযোগিতা নিয়ে তিনি এ পর্যন্ত এসেছেন।
পড়াশোনা শেষ করে কোনো একটা সরকারি চাকরি করতে চান রোজিনা। তিনি বলেন, ছোট থেকেই স্বপ্ন আছে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে চাই। এছাড়াও বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করি ভালো একটা চাকরি পাবো। আমি আমার পরিবারের অন্য ভাইবোনদের মুখে হাসি ফোটাতে চাই।
আনন্দবাজার/এম.আর