শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনিয়মেও বেড়েছে আয়

জীবন বিমা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রিমিয়াম আয় বাড়ার হিসাব বেশিরভাগই শুভঙ্করের ফাঁকি। গ্রাহকের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ না করেই বাধ্য করা হচ্ছে নতুন বিমা করার জন্য। আগের দাবির টাকা থেকে প্রিমিয়াম বাবদ টাকা কেটে রাখছে প্রায় সব কোম্পানি। যে কারণে বেড়েছে প্রিমিয়াম আয়।

প্রিমিয়াম পরিশোধ হয়েছে দুই থেকে পাঁচ বছর আগে। অথচ এখনও বিমা দাবির টাকা বুঝে পাননি হাজার হাজার গ্রাহক। চেকে বিমা দাবি পরিশোধের নামে অনিয়ম, এমনকি প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বেসরকারি খাতের এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ জমা পড়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে। তবে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ অসহায় হয়ে বলছে, জনবল সঙ্কটের কারণে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

তবে একের পর এক অভিযোগের পরও বিস্ময়করভাবে প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর। গ্রাহকরা প্রতিদিন ধর্ণা দিয়েও যখন বিমা দাবির টাকা পাচ্ছেন না, বলা হচ্ছে তাদের ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই, এমন পরিস্থিতিতেও কোম্পানিগুলোর আয়ও বেড়েছে। আইডিআরএ-এর তথ্য অনুযায়ী, জীবন বিমা ভিত্তিক ৩৩টি কোম্পানির মধ্যে ২৭টিরই বেড়েছে প্রিমিয়াম আয়। কমেছে হাতে গোনা মাত্র সাতটি কোম্পানির। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম বেড়েছে ৮১৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

আইডিআরএ-এর কাছে জমা দেয়া কোম্পানিগুলোর অনিরীক্ষিত হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত ২০২০ সালে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় ছিলো নয় হাজার ৫০১ কোটি তিন লাখ টাকা। পরের বছর ২০২১ সালে এসে ৭৫৪ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৫৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৬টি কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে এক হাজার সাত কোটি ২৮ লাখ টাকা। বাকি ছয়টি কোম্পানির আয় কমেছে ৩১০ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

আরও পড়ুনঃ  পাবনার চিনিকলে ৮০ কোটির যন্ত্রাংশে মরিচা

গেল কয়েক বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী জীবন বিমা কোম্পানিগুলো হলো- মেটলাইফ, আলফা ইসলামী লাইফ, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, আস্থা লাইফ, বেঙ্গল ইসলামী লাইফ, চার্টার্ড লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, ডেল্টা লাইফ, গার্ডিয়ান লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, যমুনা লাইফ, জেবিসি, এলআইসি অফ বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, পপুলার লাইফ, প্রগতি লাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, প্রগ্রেসিভ লাইফ, রুপালী লাইফ, সন্ধানী লাইফ, সোনালী লাইফ, সানলাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ, স্বদেশ লাইফ এবং জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স লিমিটেড।

বিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রিমিয়াম আয় বাড়ার যে হিসাব দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশই শুভঙ্করের ফাঁকি। গ্রাহকের বিমা দবির টাকা পরিশোধ না করে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে নতুন বিমা করার জন্য। আগে করা বিমা দাবির টাকা থেকে প্রিমিয়াম বাবদ টাকা কেটে রাখছে প্রায় সবগুলো কোম্পানি। যে কারণে প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোম্পানিগুলোতে উল্লেখ করার মতো গ্রাহক বাড়েনি। পুরনো গ্রাহকদের দিয়েই নতুন করে বিমা করিয়ে প্রিমিয়াম আদায় করা হচ্ছে। এতে আপাতদৃষ্টিতে প্রিমিয়াম আয় বাড়লেও ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গেল বছরে সবচেয়ে বেশি প্রিমিয়াম আয় করেছে বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান মেটলাইফ। তাদের প্রিমিয়াম আয় ছিল দুই হাজার ৯৩২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অথচ আগের বছরে তা ছিল দুই হাজার ৭৮৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানেই মেটলাইফের প্রিমিয়াম আয় বেড়ে গেছে ১৪৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। গত দুই বছরে প্রিমিয়াম আয়ের শীর্ষে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে, প্রিমিয়াম আয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে থাকা ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুরেন্স গেল বছরে প্রিমিয়াম থেকে আয় করেছে এক হাজার ৩৭৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আগের বছর প্রিমিয়াম আদায় ছিল এক হাজার ১৭৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এক বছরে তাদের আয় বেড়েছে ১৯৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

আরও পড়ুনঃ  মরুর ত্বীন চাষ নাঙ্গলকোটে

প্রিমিয়াম আয় বাড়ার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা সোনালী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডের গেল বছরের আয় ৩১৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। তার আগের বছরে (২০২০) ছিল ১৩৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক বছরে আয় বেড়েছে ১৮৫ কোটি টাকা। তবে আয়ে উপরের দিকে উঠে এলেও প্রিমিয়াম আয়ে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে।

প্রিমিয়াম আয় বাড়ার ক্ষেত্রে চতুর্থ অবস্থান রয়েছে পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানির গত ২০২০ সালের প্রিমিয়াম আয় ছিল ৫৭০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরের বছরে (২০২১) ৮০ কোটি ১৪ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৫০ কোটি ৭৭ লাখ টাকায়। পঞ্চম অবস্থানে থাকা প্রগতি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি ২০২০ সালে প্রিমিয়াম বাবদ আয় করে ৩১৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পরের বছর (২০২১) ৬৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা আয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৮৮ কোটি ১ লাখ টাকা।

অনিয়মের নানা অভিযোগেও প্রিমিয়াম আয় বাড়ার প্রসঙ্গে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুশান্ত প্রামানিক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে চারজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজ করছি। সবাই আগে কোনো না কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করে এসেছি। আগের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে গ্রাহক সেবার বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরত্ব দিচ্ছি। গ্রাহক হয়রানি বন্ধের চেষ্টা করছি। গ্রাহকের বিমা দাবির টাকা সঠিক সময়ে ফেরৎ দেয়ার চেষ্টা করছি। যে কারণে আমাদের প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে। চলতি বছরে আমাদের প্রিমিয়াম আয় দিগুণ হবে বলেই আশা করছি।

আরও পড়ুনঃ  ঢাকা থেকে ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ভাঙ্গা পৌঁছাল ট্রেন

অন্যদিকে, প্রিমিয়াম আয় কমার শীর্ষে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। বিগত ২০২০ সালে তাদের প্রিমিয়াম আয় হয়েছিলো এক হাজার চার কোটি ৩৯ লাখ টাকা। পরের বছর (২০২১) তা কমে দাঁড়ায় ৭৫৭ কোটি ২২ লাখ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে আয় কমে গেছে ২৪৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

প্রিমিয়াম আয় করার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। ২০২০ সালে প্রিমিয়াম বাবদ তাদের আয় ছিল ৩৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা। পরের বছর (২০২১) আয় কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রিমিয়াম আয় কমেছে ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। গ্রাহকের দিক থেকেও অন্যান্য বিমা কোম্পানির চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে প্রটেক্টিভ।

আয় কমার ক্ষেত্রে পরের অবস্থানে রয়েছে বেস্ট লাইফ ইন্সুরেন্স লিমিটেড। বিগত ২০২০ সালের তুলনায় পরের বছরে আয় কমেছে ১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। একইভাবে পদ্মা লাইফ ইন্সুরেন্সের আয় কমেছে ৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। তাদের ২০২০ সালে আয় ছিলো ৪৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। পরের বছরে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকা বায়রা লাইফ ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়াম আয় একেবারেই তলানীতে। ২০২০ সালে তাদের প্রিমিয়াম আয় ছিল তিন কোটি ৫৩ লাখ টাকা। পরের বছরে ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭২ লাখ টাকায়।

আইডিআরএ-এর নির্বাহী পরিচালক শাকিল আখতার দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, গ্রাহকের অভিযোগ আমলে নিয়ে কোম্পানিগুলোকে আমরা সমাধান করার কথা বলেছি। তারা সমাধান করছে কি না সে ব্যাপারে প্রতিনিয়তই মনিটরিং করা হচ্ছে। কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া বাকিরা অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়ে সজাগ থাকায় কিছুটা হলেও গ্রাহকের আস্থা এখন ফিরেছে। যে কারণে কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় বেড়ে গেছে। শাকিল আখতার জোর দিয়ে বলেন, আমরা বিমাখাতে গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে যা যা প্রয়োজন সবই করার চেষ্টা করছি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন