শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্বকবির ‘ছোট নদী’ মরছে!

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় শিশুতোষ কবিতা ছোট নদী কবিতাটি মনে নেই এমন লোক পাওয়া কঠিন। তবে অনেকেই জানেন না সেই কবিতার ছোট নদী টি শাহজাদপুরের খোনকারের জোলা নামে

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি”।

  • বাঁকে বাঁকে চলে না, হাঁটুজলও থাকে না
  • প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষুব্ধ রবীন্দ্র অনুরাগীরা

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় শিশুতোষ কবিতা ছোট নদী কবিতাটি মনে নেই এমন লোক পাওয়া কঠিন। তবে অনেকেই জানেন না সেই কবিতার ছোট নদী টি শাহজাদপুরের খোনকারের জোলা নামে পরিচিত ছিল যা প্রভাবশালী দখলদারদের নজর পরে আজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

সরকার দীর্ঘদিন ধরেই উদ্যোগ নিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী খনন করছে সারাবছর নদীতে পানি ধরে রাখতে। ঠিক তখনই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘ছোট নদী’ খ্যাত খোনকারের জোলা একেবারে অস্তিত্বহীন করে দিতে দখলের মহোৎসবে মেতে উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। অপরদিকে স্থানীয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় মনে দাগ কাটছে রবীন্দ্র অনুরাগী ও গুণীজনসহ শাহজাদপুরবাসীর। এ যেন স্থানীয় প্রশাসনের চোখে কালো পর্দা বেঁধে রাখার মতো।

ঐতিহ্য হারানো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ছোটনদী সংকুচিত ও শুকিয়ে মরে যাওয়ায় রোগাক্রান্ত কোনো বৃদ্ধের রক্তনালীর মতোই সরু হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও তো আবার দু’পাশ থেকে চাপিয়ে একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রবাহ। আর এই স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যময় নিরবতায় নির্বিঘ্নে নতুন করে নদীর ওপর বাড়িঘর নির্মাণ করে আস্তে আস্তে কবিগুরুর ছোট নদীকে গিলে খেতে শুরু করেছে ভূমিদস্যুরা।

এদিকে, কবিগুরুর নামে শাহজাদপুরে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে কবিগুরুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, কবিগুরুর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখা। সে জন্য রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এই ছোট নদীটির জীবন্ত প্রবাহই কামনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে শাহজাদপুরের গুণিজনরা বলছেন শাহজাদপুরে রবীন্দ্র আগমনের প্রধান মাধ্যমই ছিলো এই নদী। তাই এই নদীকে রুদ্ধ করার অর্থই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আগমনকে বাধা দেওয়া এবং তার ‘আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি’-কে বাধাগ্রস্ত করা।

আরও পড়ুনঃ  পঞ্চমবারের মতো জয়ী ওবায়দুল কাদের

অথচ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক এই নদীটিকে এমন ভাবে গিলে খাওয়া হয়েছে আর কয়দিন পর হয়তো কেউ জানবেই না যে ‘এইখানে এক নদী ছিলো’। মধুর সুরে কলকল করে বয়ে চলা এই নদীটার নাম ছিলো খোনকারের জোলা। রবীন্দ্র অনুসারীরা আবার আদর করে কবিগুরুর কবিতার সেই ‘ছোটনদী’ বলেও ডাকতো। শাহজাদপুর পৌর শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা এই নদী ধরেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের ভেলা নিয়ে প্রবেশ করতেন কাছারি বাড়িতে। এই জোলা দিয়ে চলতো আরও রংবেরঙের পাল তোলা বাহারি নৌকা।

এসব এখন যেন শুধুই রূপকথা বা কোনো কিংবদন্তি। সবকিছুই এখন কেবল ইতিহাস। ছোট নদীতে (খোনকারের জোলা) বর্তমানে আর পাল তোলা বাহারি নৌকা বা কবিগুরুর ‘সোনার তরী’ ভাসার উপায় নেই! এমনকি নদী ধরে পানি প্রবাহেরই আর সুযোগ নেই কোনো। ভূমিদস্যুদের দখলের কবলে পড়ে একেবারেই অস্তিত্ব হারাতে বসেছে ছোট নদীর। কালের আবর্তনে খোনকারের জোলাটি অবৈধ দখল হয়ে যাওয়ার পর থেকে এটি মূলত পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

এর আগে ২০১৮ সালে তৎকালিন শাহজাদপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ হাসিব সরকার খোনকারের জোলাটির নির্দিষ্ট স্থান জরিপের মাধ্যমে ছোটনদীর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করেন। তিনি খোনকারের জোলার ৩ কিলোমিটার এলাকা পরিদর্শন করে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। তার বদলীর পর অদৃশ্য কারণে সেই উদ্ধার অভিযানও থেমে যায়। এরপর থেকে ছোটনদী পুনরুদ্ধারে কাউকেই কোনো উদ্যোগ বা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। উল্টো যতটুকু উদ্ধার হয়েছিল সেটুকুও নতুন করে দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুরা।

আরও পড়ুনঃ  চট্টগ্রামে ১২টিতে নৌকা, স্বতন্ত্র ৩-লাঙ্গল ১টি

এদিকে, গত বছরের ১৫ অক্টোবর শাহজাদপুরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়ি পরিদর্শনে এসে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এমপি ছোটনদীসহ শাহজাদপুরে কবিগুরুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল স্মৃতি সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ায় আশ্বাস দিয়েছিলেন। আশ্বাসের এক বছর পেরিয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। সে আশাও আস্তে আস্তে হতাশার কুয়াশায় ঢেকে যেতে শুরু করেছে।

মূলত, শাহজাদপুর পৌর শহরের বুক চিড়ে আদিকাল থেকে বয়ে চলা খোনকারের জোলা দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনায় এখন মরা খাল। জোলার পূর্ব মুখ করতোয়া নদী থেকে শুরু হয়ে শহরের মাঝ বরাবর রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি দিয়ে বড়াল নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। এর মধ্যে পুকুরপাড় এলাকার করতোয়া নদী থেকে মণিরামপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার নদী কয়েকবছর আগে স্থানীয় প্রসাশন উদ্ধার করেন। এরপর থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে বড়াল অভিমুখী খোনকারের জোলার বাকি অংশটুকু বিভিন্ন সময়ে সুকৌশলে প্রভাবশালীরা পাকা স্থাপনা করায় উদ্ধার অভিযান দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় রূপ নেয়।

পরবর্তীতে তৎকালীন এসিল্যন্ড মোহাম্মদ হাসিব সরকারের বদলি হওয়ার পর উদ্ধার অভিযান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে গত কয়েকদিন যাবৎ সরকারের উদ্ধার করা অংশের রামবাড়ি এবং মণিরামপুর মহল্লাকে মিলিত করে নদীর ওপর যে সড়ক হয়েছে ঠিক তার পূর্ব পাশে জোলার পুরোভাগ জুড়ে মাটি ভরাট করে বাড়ি করার চেষ্টা করছেন শাহজাদপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মোক্তার হোসেন।

জানতে চাইলে মোক্তার হোসেন জানান, আমি জায়গা কিনে নিয়েই বাড়ি বানাচ্ছি।’ কে বিক্রি করলো ছোট নদী তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এদিকে মোক্তার হোসেন নদীর যে অংশ ভরাট করেছেন ঠিক তার অদূরে পশ্চিম পাশে ছোবাহান গং ভরাট করে নতুন করে তুলছেন পাকা ঘর। তাদের কাছে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর মেলেনি।

আরও পড়ুনঃ  অলটেক্সের মজুদ পণ্যে নিরীক্ষকের আপত্তি

এভাবেই কখনো মোক্তার হোসেনের মতো প্রভাবশালীরা আবার কখনো সোবহানদের মতো মানুষেরা বিভিন্ন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় একটু একটু করে দখল করতে করতে হাতের মুঠোর মধ্যে টেনে নিচ্ছে পুরো নদী। নদী রক্ষায় বিভিন্নভাবে শাহজাদপুরের সচেতন মহল থেকে দাবি করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে সুযোগ সন্ধানীরা দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ অনেকের।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শাহ আজম প্রতিবেদককে বলেন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকে আমাদের মাঝে চির অম্লান করে রাখার জন্য এই নদীটির জীবন্ত প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানাচ্ছি।

রবীন্দ্র অনুরাগী রবীন্দ্র পাঠকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক শাহ আলমের জানান, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের আগমনে আমরা ধন্য। আর রবীন্দ্রনাথের এই আগমন সড়কপথ, রেলপথ বা বিমানপথে ঘটেনি; ঘটেছে নৌপথে নৌকাযোগে। তার নৌকা বা বোট শাহজাদপুরে ঢুকেছে ‘ছোট নদী’ বা খোনকারের জোলা দিয়ে।

শাহজাদপুরে রবীন্দ্র আগমনের প্রধান মাধ্যমই ছিলো এই নদী। তাই এই নদীকে রুদ্ধ করার অর্থই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আগমনকে বাঁধা দেওয়া এবং তার ‘আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি’কে বাধাগ্রস্ত করা। এই নদীটি সচল হলে শাহজাদপুর শহর যেমন প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি পর্যটকরাও রবীন্দ্রনাথকে বাস্তবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।

এবিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন জানান, ‘ছোট নদী’ ‘খোনকারের জোলা’ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় আমার নজরে আছে। শাহজাদপুর সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। উনি পরিদর্শন শেষে জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অপরদিকে, শাহজাদপুর সহকারী কমিশনার (ভূমি) লিয়াকত সালমান জানান, সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে। এক দুদিনের মধ্যেই পুনরায় জরিপ করে সীমানা নির্ধারণসহ ‘ছোট নদী’ উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন