শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লোকসান-পাচার রোধে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি

লোকসান-পাচার রোধে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানোসহ পাচার হওয়ার শঙ্কা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে এক ব্যাখ্যায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব জানান।

এর আগে গত শুক্রবার রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাত ১২টার পর থেকে ডিপোর ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল ১৩০ টাকা হবে। নতুন নিয়মে, ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটার প্রতি ৩৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা এবং পেট্রল ৪৪ টাকা। এতোদিন কেরোসিন ও ডিজেল প্রতি লিটার ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা এবং পেট্রোল ৮৬ টাকায় বিক্রি হয়।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গতকাল শনিবারের এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, সর্বশেষ গত বছরের ৩ নভেম্বর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে কেবল ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য বৃদ্ধি করে পুনর্নির্ধারণ (ডিজেল ৮০ টাকা ও কেরোসিন ৮০ টাকা) করা হয়। ওইসময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা সত্ত্বেও অকটেন ও পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কিছুটা কমায় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য আরও বেড়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ  বিশ্বাস ভঙ্গের ১৮২ বছর

আন্তর্জাতিক বাজারে যদি ডিজেল প্রতি ব্যারেল ৭৪ দশমিক শূন্য ৪ ডলার এবং অকটেন প্রতি ব্যারেল ৮৪ দশমিক ৮৪ ডলারে নেমে আসে, তবে ডিজেল ও অকটেন প্রতি লিটার যথাক্রমে ৮০ টাকা ও ৮৯ টাকায়, অর্থাৎ বিদ্যমান মূল্যে বিক্রয় করা বিপিসির পক্ষে সম্ভব হতো, যা এখন প্রায় অসম্ভব। একইভাবে ক্রুড অয়েলের মূল্য এ বছরের জুনে ব্যারেলপ্রতি ১১৭ মার্কিন ডলার অতিক্রম করে, যা এখনও অব্যাহত আছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে সর্বশেষ গত জুলাই মাসের গড় প্লাস রেট অনুযায়ী বিপিসির দৈনিক লোকসানের পরিমাণ ডিজেলে প্রায় ৭৪ কোটি ৯৪ লাখ ৯২ হাজার ৭০০ টাকা ও অকটেনে প্রায় ২ কোটি ৯২ লাখ ২৩ হাজার ২১৬ টাকা। মোট প্রায় ৭৭ কোটি ৮৭ লাখ ১৫ হাজার ৯১৬ টাকা। গত মে ও জুনে লোকসান ছিল শতাধিক কোটি টাকা।

ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসির প্রকৃত লোকসান বা ভর্তুকি দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ মূল্য সমন্বয়ে ডিজেলের মূল্য ১১৪ টাকা করা হলেও গত জুলাইয়ের গড় হিসাবে প্রতি লিটারে খরচ পড়বে ১২২ দশমিক ১৩ টাকা, অর্থাৎ প্রতি লিটারে তার পরও ৮ দশমিক ১৩ টাকা লোকসান বিপিসিকে বহন করতে হবে। গত ১২ জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় ডিজেল লিটারপ্রতি ৯২ দশমিক ৭৬ রুপি বা সমতুল্য ১১৪ দশমিক শূন্য ৯ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে, যা বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ টাকা বেশি এবং পেট্রোল লিটারপ্রতি ১০৬ দশমিক শূন্য ৩ রুপি বা সমতুল্য ১৩০ দশমিক ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা বাংলাদেশ থেকে ৪৪ দশমিক ৪২ টাকা বেশি। এ পার্থক্যের কারণে বহু কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে আমদানিকৃত জ্বালানি পণ্য পাচার হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান। তাই মূল্য সমন্বয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের জ্বালানি পণ্যের মূল্যের পার্থক্যজনিত পাচার রোধ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  বিশ্বে কমে দেশে বাড়ে

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিপিসির আর্থিক সক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। জ্বালানি পণ্যের বিদ্যমান হারে তেল বিক্রয় ও অন্যান্য আয় খাতে গড়ে বিপিসির মাসিক জমা/আয় প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এলসি পেমেন্টসহ অন্যান্য খাতে বিপিসির ব্যয় বর্তমানে সর্বশেষ জুলাই মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩১২ দশমিক ৭৬ কোটি টাকা। বিপিসির জ্বালানি তেলের অর্থায়নের জন্য দুই মাসের আমদানি মূল্যের সমান হিসেবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসেবে সংস্থান রাখা আবশ্যক। বর্তমানে চলতি মূলধন হ্রাস পাওয়ায় গত মার্চ থেকে অদ্যাবধি উন্নয়ন প্রকল্প ও বিবিধ খাত থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করে ভর্তুকিসহ জ্বালানি তেলের মূল্য ও অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। গত ৩১ জুলাই বিপিসির হিসাবে সামগ্রিকভাবে অর্থ জমা ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে আগস্ট মাসের পর আমদানি ব্যয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে না।

উল্লেখ্য, বিপিসির জন্য জাতীয় বাজেটে কোনো অর্থ সংস্থান রাখা হয়নি। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক পেমেন্ট অবিস্মিত রাখার মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে বিপিসির আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখা জরুরি। ২০১৬ সালে সরকার যখন জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করে পুনর্নির্ধারণ করে, তখন ডলার ও টাকার বিনিময় হার ছিল ৭৯ টাকা। গত বছরের ৩ নভেম্বর সরকার যখন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে, তখন ডলার ও টাকার বিনিময় হার ছিল ৮৫ দশমিক ৮৫ টাকা, যা বর্তমানে ৯৩ দশমিক ৫০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ডলারের চাপে রিজার্ভ

অধিকন্তু বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকসমূহ বিসি রেটে বিপিসির এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করায় বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কেট রেটে ডলার সংগ্রহের নির্দেশনা প্রদান করে। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসির ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বিপিসিতে তার পরিচালন সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। এগুলো হলো সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডবল পাইপলাইন, ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন, জেট এ-১ পাইপলাইন এবং ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন। তাছাড়া ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পের সমুদয় অর্থ (১৯ হাজার ৪০৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা) বিপিসির নিজস্ব তহবিল হতে সংস্থানের জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ডিপিপি অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা না হলে বর্ণিত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে বিপিসি আর্থিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন