- পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে: মঞ্জুর হোসেন, জ্যেষ্ঠ গবেষক, বিআইডিএস
- এ মুহূর্তে দেশে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার: সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
- বিলাসী সব পণ্য আমদানির শুল্ক বাড়িয়েছি, এতে সুফল আমরা পাব: সিরাজুল ইসলাম, মুখপাত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক
- তিন মাসের আমদানি ব্যয় থাকলেই মজবুত অর্থনীতি। আমাদের আছে ৫ মাসের অধিক: আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব
- রেমিট্যান্স আর রপ্তানি আয়েই ডলারের মূল চাহিদা পূরণ হবে: অর্থমন্ত্রী
আমদানি দায় মেটাতে চাহিদা বাড়ছে ডলারের। তবে বাড়ছে না রপ্তানি, আগের মতো আসছে না রেমিট্যান্স। এতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে আয়ের তুলনায় ডলারের ব্যয়। যে কারণে হুহু করে বাড়ছে বৈদেশিক এই মুদ্রার দাম। মান হারাচ্ছে দেশীয় মুদ্রা টাকা। খোলাবাজারে ডলারের দাম পরিবর্তন হচ্ছে যখন-তখন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দাম মানছে না অনেক ব্যাংক। সবমিলিয়ে বাজারে তৈরি হচ্ছে অস্থিরতা। সংকট নিরসনের সব চেষ্টাই যেন মুখ থুবড়ে পড়ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিদিনই বিক্রি করতে হচ্ছে ডলার। এতে আশংকাজনকভাবে কমতে শুরু করেছে রিজার্ভ। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপদজনক মাত্রায় চলে গেছে। তবে সরকারপ্রধান বলছেন, তিন মাসের খাদ্য কেনার মতো রিজার্ভ থাকাই যথেষ্ট।
করোনায় বিশ্বব্যাপী তৈরি হয়েছিলো অস্থিরতা। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়েছিলো নাজুক। তবে তখনও শক্ত অবস্থানেই দাঁড়িয়ে ছিলো বাংলাদেশ। কারণ, পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। সে সময় সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন তারা। এতে সংকট তৈরি হয়নি ডলারের। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই কমতে শুরু করে প্রবাসী আয়। এরমধ্যে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বন্ধ হয়ে যায় কয়েকটি দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। এতে সংকট বাড়তে থাকে দেশে। রেমিট্যান্স না আশায় ডলার সংকট দাঁড়ায় চরমে। পরিস্থিতি এমন যে রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এতে রিজার্ভ সংকটে পড়লেও কাটছে না ডলার সংকট।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে তা দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। তবে সরকার এই পরিস্থিতিকে এখনও আশঙ্কাজনক মনে করছে না। যদিও রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে করা হচ্ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। নেয়া হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত ৪০ বিলিয়ন বা চার হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্যে এখন রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে। গত ২৭ জুলাই বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে ৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডরারের দাম নির্ধারণ করেছিলো ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। দিন শেষে রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৯৪৯ কোটি (৩৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ-এই নয়টি দেশ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর পরিশোধ করতে হয়। সর্বশেষ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় শোধ করতে হয়েছে। এতে রিজার্ভ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি মাসে আট বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে এই অর্থ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না অনেক অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার বললেও এ সংখ্যা আরো কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জ্বালানি, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন) থেকে কমে হয়েছে ৩ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলার (৩৯.৪৯ বিলিয়ন)। অর্থনীতি চাপে পড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে কতটা প্রয়োজন হয়ে ওঠে, এর ফলে তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
তবে সালেহউদ্দিন আহমেদেতর মতে, এ মুহূর্তে দেশে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি বা ৩১ বিলিয়ন ডলার। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, বিভিন্ন খাতে রিজার্ভ থেকে দেওয়া আছে ৮ বিলিয়ন ডলার, যা চাইলেই সহজে ফেরত পাওয়া যাবে না। সংকট বাড়লে পুরো রিজার্ভও ব্যবহার করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলছেন, আইএমএফও বাংলাদেশ ব্যাংককে সঠিকভাবে রিজার্ভের হিসাবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছে। অবশ্য তাদের হিসাবে ধরলেও বাংলাদেশে যে প্রকৃত রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে তিন মাসেরও বেশি আমদানি দায় পরিশোধ করা যাবে। তবে তিনি আইএমএফের প্রশ্ন তোলাকে যৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, রিজার্ভ যতটুকু ব্যবহারযোগ্য, তা–ই বলা উচিত। কারণ, এটা সংকটের সঙ্গী।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ যা বলা হচ্ছে, সেটাও দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদ সংকেত। এ মুহূর্তে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ আছে, তা তিন মাসের আমদানি মূল্যেরও কম হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য এই পরিমাণ মজুদ একটা বিপদ সংকেত।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক মঞ্জুর হোসেন বলেন, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকারদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আমদানিনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বেশ কিছু বিলাসী পণ্যের আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানির লাগাম কিছুটা কমবে। তবে আরেকটি বিষয় খুব তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে, পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস বলেন, তিন মাসের আমদানি ব্যয় থাকলেই তাকে মজবুত অর্থনীতি বলে। আমাদের ৫ মাসের অধিক আমদানি ব্যয় আছে। এর আগে বলা হতো, ৩ মাসের খাদ্য আমদানির ক্যাপাসিটি আছে কি না। এখন আমরা শুধু খাদ্য আমদানি হিসাব করি না, আমাদের মোট যে আমদানি হয় সেটা হিসাব করছি। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের ৫ মাসের বেশি আছে। অতএব আমাদের ঝুঁকি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকলে সেটা কোনো বিপদ সংকেত দেয় না। আমাদের কাছে এখন যে রিজার্ভ আছে, সেটা তিন মাসেরও বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। এখন আমরা বিলাসী সব পণ্য আমদানির শুল্ক বাড়িয়েছি। আশা করি, তার সুফল আমরা পাব।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, রিজার্ভ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু নেই। আমাদের রিজার্ভ যখন ৩০ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল, তখন তো আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম। ৩০ বিলিয়নে যদি খুশি হই, তাহলে এখন কষ্ট পাওয়ার কী আছে।
ডলার সংকট নিয়ে গত ২৭ জুলাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমেই ডলারের মূল চাহিদা পূরণ হবে। এবছর আমরা বিশ্বাস করি রেমিট্যান্স অনেক বাড়বে। কারণ এরই মাঝে প্রচুর শ্রমিক ভাই-বোন বিদেশে গেছেন। কোভিড পিরিয়ড পার হওয়ার পর তারা গেছেন। এখন তারা স্যাটেলে হবেন এবং রেমিট্যান্স অর্জন করে দেশে পাঠাবেন। রেমিট্যান্স এবং এক্সপোর্টের মাধ্যমে আমাদের ডলারের চাহিদা পূরণ হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেছেন, দেশের কিছু মানুষ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অযৌক্তিক মন্তব্য করছেন। তারা মূলত গুজব ছড়াচ্ছেন। রিজার্ভ কম-বেশি হবে এমনটা প্রচলিত আছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য রপ্তানির ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর হলে চলবে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য আমাদের রপ্তানির দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশে নতুন বাজার খুঁজতে আমাদের স্থানীয় পণ্যে বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য এনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাস ধরেই রিজার্ভ কমছে। যদিও এর আগে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছিলো। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার হয়।