শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বপ্নের নতুন দিগন্তের হাতছানি

  • অন্তত একটি ভালো কাজের শপথ নিই
নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে আমরা সেই গান গাইতে চাই না, যে গান আমাদের বিবেক ও চেতনাকে নাড়া দেয় না। কেন আমরা বলবো, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। পেছন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে মহাকালের দ্বারপ্রান্তে। যেখানে শুধুই থাকবে সমৃদ্ধির ভাবনা, আনন্দ আর উচ্ছাস। কী পেলাম, কী হারালাম সেদিকে নজর না-দিয়ে সকলে মিলে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যাই সামনে আরো সামনে। স্বপ্নের নতুন দিগন্ত যেদিকে হাতছানি দিচ্ছে। সব দলমতের উর্ধ্বে থেকে সবাই মিলে দেশটা গড়ার চেতনায় বলিয়ান হই। কারণ সামনে রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা আর আত্মনির্ভর হয়ে গড়ে উঠার সুযোগ। নতুন বছরের উদয়মান সূর্য্যের আলো ছুঁয়ে সেই মহান শক্তিমানের কাছে আমরা প্রাণ খুলে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের বিবেককে জাগ্রত করেন।

নিশি অবসানপ্রায়
ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত
বছরের শেষ সূর্যাস্ত সকল অন্ধকার
জরাজীর্ণকে গ্রাস করে নিয়ে যাক অস্তাচলে।

নিদারুণ এক অস্থিরতার মধ্যে পেরিয়ে গেল একটি বছর। আমরা হারালাম অনেক দেশবরেণ্য গুণীজনকে। বছরের মাঝপথে যদিও কমতে শুরু করে কোভিড। সাধারণ মানুষের আয় রোজগারের পথে ঘাটতি শুধু কোভিডের কারণেই- একথা বলার অবকাশ নেই। আমি ঢালাওভাবে সব মানুষের কথা বলছি না, বলছি খেটে-খাওয়া নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত অনেকের কথা বলছি। বাজারে অবশ্য তার কোনো ছাপ নেই। শপিংমল বিপণিবিতান থেকে শুরু করে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় মার্কেটে কেনাবেচা চলছে পুরোদমে। কারা এসব মানুষ! ষোল থেকে বিশ হাজারে এক হালি ইলিশ, পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজারে নামিদামি ব্র্যান্ডের পোশাক।

মানুষের গড় আয় বেড়েছে, পুস্তকি ভাষায়- হিসেব নিকেশের আওতায় বিষয়টা সত্য। কিন্তু বিগত দুই বছরে দরিদ্র মানুষ আরো কত দরিদ্র হয়েছে প্রাকৃতিক এই মহামারীতে তার সঠিক পরিসংখ্যান কেইবা করেছে। মধ্যবিত্তের একটা বিশাল শ্রেণী, যারা না পেরেছে হাত পাততে, না গিয়েছে সাহায্য আনতে, বোবা দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে। পরিবারের জন্য ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। এই শ্রেণির পরিসংখ্যান কে করেছে?

আরও পড়ুনঃ  উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্য, সমাধান কোন পথে?

বছরের শেষ দিকে এসে আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা, ডিজেল পেট্রোল, ভোজ্য তেল থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস- সব কিছুর দাম প্রায় বাড়তি। মাছে ভাতে বাঙালি- এই প্রবাদ বাক্য এখন সবাই প্রায় ভুলতে বসেছে। আলু ভাতে বা ডালে ভাতে বাঙালি- এই কথাটি ভাবতেও এখন কষ্ট হচ্ছে। চার পাঁচ সদস্যের একজন দিনমজুর কীভাবে চালিয়ে নিচ্ছে তার সংসার, ভাবলে অবাক হতে হয়। তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখছে নতুন করে বাঁচার।

মানুষের সচেতনতা আর সরকারি সতর্কতায় ভয়াবহ কোভিড এখন নিয়ন্ত্রণে। স্কুল-কলেজ খুলে গেছে। পরীক্ষাগুলো হচ্ছে সময়মতো। মানুষ তার দৈনন্দিন কাজ-কর্মে আবারো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাঙালির একটা ভালো দিক হচ্ছে তাদের অধিকাংশই স্বপ্নবাজ। কোনো একটা স্বপ্নকে আকড়ে ধরে তারা এগোতে চায় সুদিনের সন্ধানে। আর তাইতো সময় তাদের এগিয়ে নিয়ে যায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে।
২.
সেদিন এক বন্ধুর সঙ্গে ফকিরাপুলে দেখা। পেশায় প্রিন্টিং সাপ্লায়ার। বললাম কেমন আছ? বললো,
মন্দ ভালোয় কাটছে দিন। এটা আবার কেমন? সে বললো, ‘কোভিডের মন্দ সময় পার করতে করতে হঠাৎ করে ভালো সময় চলে এলো। কাজ-কামে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আগের মতো এখন আর কাজ কোথায়। সবাই যে যার মতো কেবল চালিয়ে নিচ্ছে। তার ফাঁকেও কিছু ছিটেফোঁটা কাজ দিয়ে সংসার চলে যায়। এই যে দেখছো ফকিরাপুল, এখানে একটা ব্যাগ আর সামান্য কিছু পুঁজি নিয়ে ভ্রাম্যমাণভাবে কাজ করে চলছে অনেক তরুণ কিশোর। আমাদের কথা ভাবছে কে?’

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে ভালো সরকারি চাকরি না পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্ঠায় এখনো সংগ্রাম চালাচ্ছে বন্ধুটি আমার। বললাম তোমার না অফিস ছিল ইস্কাটনে। ও বললো, ‘কোভিড খেয়ে ফেলেছে। এখন পল্টনে শেয়ার করি অন্যের অফিসের একটি কক্ষে। কাজ থাকলে দিস। এই আমার নম্বর। পাঁচ পারসেন্ট লাভে করে দেব।’ মাত্র পাঁচ! অর্থাৎ এক হাজারে পঞ্চাশ টাকা। অথচ কত সহজে আমরা অনেকেই এক লাখ টাকার কাজ পঁচিশ তিরিশ হাজারে সেরে রাতে দিনে পকেট ভারী করছি।

আরও পড়ুনঃ  তেসরা নবেম্বর কলঙ্কিত আরও এক অধ্যায় 

মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার সেই নীতি কথা। পাঠ্যপুস্তকে লেখা, অসৎ পথে চলিও না, সদা সত্য কথা বলিবে, গুরুজনকে মান্য করিবে। সেইসব গুরুজনের আজ বড়ই অভাব। যাঁরা নিজের জীবন বিপন্ন করে আগামি প্রজন্মকে তৈরি করবে। শেখাবে বিভিন্ন নীতি কথা। আর সেসব মেনে চলার নিয়মাবলি। যাই হোক হাঁটতে হাঁটতে বললাম, আমার কিছু প্যাড ছাপতে হবে। চার রং-এ ছাপা হবে। ডিজাইন পেন ড্রাইভে আছে তুমি করে দাও। সে বললো, ‘টাইম সর্ট। হাতে কিছু কাজ আছে। এক আমলা বন্ধুর ছেলের, তুমি চেনো, বিশ হাজারের মতো খরচ হবে, হাজার দেড়েক থাকবে।’ অবাক হলাম তার সহপাঠী এই বন্ধুটির কথা ভেবে। ইচ্ছে করলে সে তার এই বন্ধুটিকে কাজ দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারতো। আসলে অপ্রিয় হলেও সত্য ক্ষমতা অথবা চেয়ারে বসলে আমরা অনেকেই ভুলে যাই প্রিয় সেইসব বন্ধুদের বা আপনজনের কথা। যারা একসময় ছিল আমার আনন্দ বা সুখ-দুঃখের সাথী। তা না হলে হাবিবকে (রুপক নাম) কেন এখনো ব্যাগ হাতে ঘুরতে হবে ফকিরাপুলে কাজের সন্ধানে।

হাবিবের এতে কোনো আক্ষেপ নেই। তার মতে জীবন তো চলে যাচ্ছে। চুরি তো করিনি। হাত তো পাতিনি। তবে কষ্ট হয় মাঝে মধ্যে। আবার ভালো সময়ও কাটিয়েছি। তাই এখন মন্দভালোর দোলায় আছি। হাবিব মাঝে মধ্যে কবিতা লিখতো। বললাম, লেখালেখি করো এখনো? ও বললো, ‘ওসব কি ছাড়া যায়? যেমন তুমি কি গান বাজনা ছাড়তে পেরেছো? বললাম, না, ‘তবে এখন আর প্রতিবাদী গান গাইতে ইচ্ছে করে না। যখন দেখি একই মানুষের দু’রকম চেহারা, তখন মনে হয় আমরা অনেকেই এই সমাজের জন্য একবারেই আনফিট। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊণসত্তরের গণঅভুৎত্থান, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে গানে, কবিতায়, নাটকে আমাদের যে চেতনা জাগ্রত হতো তা গেল কোথায়! এখন আমাদের কাজ কথায় একটাই স্লোগান ধ্বনিত হোক, ‘দুনীতি বন্ধ হোক, মানুষের বিবেক জাগ্রত হোক’।
৩.
মানুষের জীবন রক্ষাকারী ঔষধ কেন নকল হবে? টাকার কাছে মেধা মূল্যহীন হবে কেন? শিক্ষিত যুবকটি দেশে কর্মসংস্থান না করতে পেরে কেন বিদেশমুখি হবে? ধর্মের অপব্যাখ্যার ফাঁদে পা দিয়ে আমার সন্তান কেন সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হবে? মাত্র কটা টাকা লাভের আশায় আমার সন্তানের হাতে কেন ভিড়িয়ে দেব মাদক ব্যবসা। একজন মানুষ হিসেবে আমার প্রাপ্য অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-চিকিৎসা থেকে কেন বঞ্চিত হবে আমার সন্তান, আগামি প্রজন্ম? আজ সময় এসেছে বুকে হাত দিয়ে এসব বিষয় ভাববার। তা না হলে আমরা সামাজিকভাবে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো। মহাকাল আমাদের ক্ষমা করবে না।

আরও পড়ুনঃ  ধর্ষক মুক্ত বাংলাদেশ চাই

নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে আমরা সেই গান গাইতে চাই না, যে গান আমাদের বিবেক ও চেতনাকে নাড়া দেয় না। কেন আমরা বলবো, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। পেছন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে মহাকালের দ্বারপ্রান্তে। যেখানে শুধুই থাকবে সমৃদ্ধির ভাবনা, আনন্দ আর উচ্ছাস। কী পেলাম, কী হারালাম সেদিকে নজর না-দিয়ে সকলে মিলে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যাই সামনে আরো সামনে। স্বপ্নের নতুন দিগন্ত যেদিকে হাতছানি দিচ্ছে। সব দলমতের উর্ধ্বে থেকে সবাই মিলে দেশটা গড়ার চেতনায় বলিয়ান হই। কারণ সামনে রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা আর আত্মনির্ভর হয়ে গড়ে উঠার সুযোগ। নতুন বছরের উদয়মান সূর্য্যের আলো ছুঁয়ে সেই মহান শক্তিমানের কাছে আমরা প্রাণ খুলে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের বিবেককে জাগ্রত করেন। তিনিই আমাদের মানুষরূপে তাঁর এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কল্যাণের জন্য, সৃষ্টির জন্য, ঘৃণা বা ধ্বংসের জন্য নয়। আর শপথ নেই, এই নতুন বছরে অন্তত একটি ভালো কাজ আমি করবো। যে কাজে শক্তিমান হবে আমার আগামি প্রজন্ম। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব থাকবে নিরাপদ। তাহলেই আমার মানবজনম হবে ধন্য।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন