শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অপরিকল্পিত উন্নয়নে ৪ কোটি জলে!

অপরিকল্পিত উন্নয়নে ৪ কোটি জলে!
  • শহর থেকে ৫ কিমি দূরে বাসটার্মিনাল
  • একযুগ আগে নির্মিত টার্মিনালটি প্রায় পরিত্যক্ত

একযুগ আগে মৌলভীবাজার পৌরশহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে যুগিডহরে নির্মাণ করা হয় পৌর বাসটার্মিনাল। এতে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। তবে মোটা অংকের অর্থ ব্যয়ে নির্মিত বাসটার্মিনালটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাসটার্মিনালটির করুণচিত্র বলে দিচ্ছে এটি নির্মাণে কোনো সুপরিকল্পনা ছিলো না। স্থানীয়দের অভিমত, রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরিকল্পিতভাবে পৌরশহর থেকে ৫ কিমি. দূরে বাসটার্মিনাল নির্মাণ করায় সরকারের ৪ কোটি টাকাই জলে গেছে। তবে বর্তমান পৌর মেয়র শ্রীমঙ্গল সড়কে নতুন করে বাসটার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে বাসটার্মিনালের মধ্যে নেই একটি যানবাহনও। পুরো ভবনটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনের পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গরুর গোবরসহ নানা ধরনের আবর্জনা। মেঝের টাইলস ভাঙা। দেয়ালের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়েছে ফাটল। টার্মিনালে যানবাহন না আসার কারণে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার নামে বরাদ্দকৃত কাউন্টারগুলো বন্ধ। টার্মিনালের পূর্বদিক আবর্জনা, গরু-মহিষ আর ছাগলের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভবনটির বাইরে ও ভেতরে রড-সিমেন্ট ও বালু ফেলে রাখা হয়েছে। এতেই সীমাবদ্ধ নয়, সন্ধ্যা থেকে রাত্রীকালীন সময়ে টার্মিনাল এলাকা মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীসহ অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মৌলভীবাজার মূল সড়কের উপর বাসস্ট্যান্ড গড়ে উঠায় শহরে যানজটের অন্যতম কারণ। বাসটার্মিনালে যাত্রীবাহি পরিবহন না গিয়ে শহরের প্রধান সড়কগুলোতে অবস্থান করে যাত্রী উঠানামা করার কারণে শহরজুড়ে অসংখ্য গাড়ি স্ট্যান্ডের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের চুবরা এলাকার কোদালি সেতু সংলগ্ন এলাকা থেকে কুসুমবাগ হয়ে যুগিডহর এলাকা পর্যন্ত অন্তত ৬ স্থানে আন্তঃজেলা ও অভ্যন্তরীণ রুটের বাস-মিনিবাস দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করছে। এসড়কটি ছাড়াও শহরের একাধিক স্থানে রয়েছে মাইক্রোবাস, মিশুক, অটোরিকশা, টমটম, ইজিবাইকের স্ট্যান্ড। পাশাপাশি সেন্টাল রোডের পশ্চিম বাজার এলাকা, কোর্ট রোডের মনু সেতুর কাছে থেকে পৌরসভার অফিস সম্মুখ পর্যন্ত এবং সমশেরনগর সড়কে চৌমোহনা থেকে শাহ্ মোস্তফা কলেজ পর্যন্ত ছোট-বড় অনেক অবৈধ গাড়িরস্ট্যান্ড রয়েছে। এসব অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে শহরে যানজট লেগেই থাকে। সাধারণ পথচারিদের চলাচল বাধাঁগ্রস্ত হচ্ছে। অহরহ ঘটছে দূর্ঘটনা।

আরও পড়ুনঃ  অধরা এক নীলবঙ্গ

পৌরসভা, পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার শহরকে যানজটমুক্ত করার জন্য শহর এলাকার সড়ক থেকে অবৈধ স্ট্যান্ড সরিয়ে নিতে পৌর বাসটার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছিল। মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে এবং ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে পৌরসভার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে যুগিডর এলাকায় টার্মিনালের অবস্থান। প্রায় তিন একর জায়গার মধ্যে নগর পরিচালনা, উন্নীতকরণ অবকাঠামো প্রকল্প ও পৌরসভার যৌথ অর্থায়নে এ বাসটার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। এতে জমি কেনা, ভবন নির্মাণ ও অন্যান্য খাতে খরচ হয় ৩ কোটি ৯৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫১৯ টাকা। কাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন বাসটার্মিনালটির উদ্বোধন করেন। তবে পরিবহন মালিকদের অনীহাসহ নানা কারণে বাসটার্মিনালটি তখন চালু করা যায়নি। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে ২০১০ সালের ১ নভেম্বর থেকে বাসটার্মিনাল চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। চালুর পর ঢাকা-মৌলভীবাজার, সিলেট-হবিগঞ্জ, কুমিল্লাসহ আন্তঃজেলার বিভিন্ন বাসটার্মিনাল থেকে চলাচল করে। বিভিন্ন গ্রামীণসড়কে চলাচলকারী কিছু অটোরিকশাও টার্মিনাল থেকে আসা-যাওয়া করে। তবে কিছুদিন যাওয়ার পরই বাসগুলো টার্মিনাল থেকে সরিয়ে অবৈধ স্ট্যান্ডে চলে গেলে টার্মিনাল পুরোনো নীরবতায় ডুবে যায়।

সরেজমিনে টার্মিনালের প্রবেশমুখের চা-স্টলের মালিক মিজানুর রহমান ও পশ্চিম পাশে চা দোকানের মালিক জুনেল আহমদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, শুধু হবিগঞ্জ-সিলেট রুটের বাস রাস্তার মধ্যে সামান্য সময়ের জন্য থামে। টার্মিনালের ভেতরে ঢুকে না। আর কোনো বাস থামে না। রাতে হানিফ, শ্যামলী, তাজ পরিবহন ও কুমিল্লার দু-চারটি বাস এখানে রাখা হয়। ভোরে চলে যায়। একজন নৈশপ্রহরী আছে। আর কেউ নেই। আগে শুধু রাতের বেলা টার্মিনালের লাইট জ্বালানো হত। এখন আর লাইট জ্বলে না।

আরও পড়ুনঃ  নির্বাচনী লড়াইয়ে ২৮ ইঞ্চি প্রার্থী

বাসটার্মিনালের মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল হান্নান বলেন, আমি বাসটার্মিনাল উদ্বোধন পর থেকে দায়িত্বে আছি। এ টার্মিনালের ইজারাদার মোমিত মিয়া দায়িত্বে আছেন। তিনি মূলত ঠিকাদার। কয়েক বছর ধরে বিদ্যুৎ নাই। পানি নাই। নামাজে আসা মুসল্লিদের অজুর পানির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। বালতি দিয়ে পানি নিয়ে আসি। তারপর মুসল্লিরা অজু করে নামাজ পড়েন। তিনি আরো বলেন, মাঝে মধ্যে আলোচনা করেন। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা দূরপাল্লার গাড়িসহ সব গাড়ি এখানে আসবে। হানিফ ও শ্যামলী নানা অজুহাত দেখিয়ে তারা বাসটার্মিনালে আসে না।
মৌলভীবাজার মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ বলেন, শহরের যানজট নিরসনের জন্য সরকারিভাবে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে এ টার্মিনালটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বাসটার্মিনাল চালুর বিষয়ে সাবেক মেয়র উদ্যোগ নেওয়ায় সবার আগ্রহ ছিল। তবে বাসের কিছু নেতৃবৃন্দের আগ্রহ না থাকার কারণে দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

এদিকে নতুন করে আবারও বাসটার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান বলেন, ঢাকা সিলেট মহাসড়ক শায়েস্থাগঞ্জের মিরপুর হয়ে শেরপুর দিয়ে সিলেট চলে গেছে। যার কারণে বাসটার্মিনালের কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না। এখন শ্রীমঙ্গল সড়কে বাসটার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, টার্মিনালটি অকার্যকর হয়ে আছে। এ টার্মিনালটি সচল করার পাশাপাশি শহরের বাহিরের বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনগুলোকে সেখানে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তিনি আরো বলেন, কিছু লোকজন আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিধায় টার্মিনালটির এ অবস্থা।

আরও পড়ুনঃ  থার্টিফার্স্ট নাইটে নিরাপত্তায় থাকছে বিজিবির ডগ স্কোয়াড

আনন্দবাজার/এম.আর

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন