শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুমিল্লায় পুকুর-দিঘি ভরাট করে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন

রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনের নিরবতায় কুমিল্লা নগরীতে গত ত্রিশ বছরে শতাধিক পুকুর-দিঘী ও জলাধার ভরাটের ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে কুমিল্লার পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সিন্ডিকেট করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় দিঘি, পুকুর, জলাধার ভরাটের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। নগরীর দক্ষিণাংশ ছাড়া দেড়শো পুকুর-দিঘির মধ্যে বর্তমানে ৫০টিরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না ব্যাংক ও ট্যাঙ্কের শহর কুমিল্লায়। নাগরিক সমাজ ও পরিবেশবিদরা মনে করছেন নগরীতে বর্তমানে যেসব পুকুর দিঘি রয়েছে তা সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন করে পুকুর-দিঘী খননের উদ্যোগ ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয়মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

এদিকে ক্রমাগত দিঘি-পুকুর ভরাটের কারনে নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটানোর আধারগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নগরীতে পানিবদ্ধতা ও বিভিন্ন এলাকায় পানির নিত্য ব্যবহার সংকট দেখা দিয়েছে। পুকুর দিঘি জলাধারের অভাবে আগুন নেভাতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটকে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের হিসেব অনুযায়ি নগরীর দক্ষিণাংশের বাইরে দেড়শো পুকুর-দিঘী ছিল। কুমিল্লা শহরের প্রায় দেড়শো পুকুর-দিঘির মধ্যে বর্তমানে ৫০টিরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভূমি সিন্ডিকেটের নজর পড়ায় এগুলোতে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল ভবন। কুমিল্লায় পুকুর দিঘী জলাধার ভরাটের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা নেই বললেই চলে। পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলোও আন্দোলন জোরদার করতে পারছেনা। আর কুমিল্লায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারারা পুকুর-দিঘী ভরাটের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভরাট কাজ বন্ধ করে দিয়ে মামলা ঠুকে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। কিন্তু পরে আর খবর রাখেন না পুকুর বা দিঘীটি কী অবস্থায় রয়েছে। মাস খানেক পর গিয়ে দেখা যায় ভরাট কাজ বন্ধ করা ওই পুকুর বা দিঘীর অস্তিত্ব নেই। সেখানে চলছে প্লট বরাদ্দের কারবার। কুমিল্লা নগরীতে বেশ কটি পুকুর দিঘী ভরাটের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করলেও ফলাফল শুভঙ্করের ফাঁকি। আসলে সরিষায় ভূত থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন নাগরিক সমাজ। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত ত্রিশ বছরে নগরীর আশি ভাগ পুকুর দিঘী জলাধার ভরাট হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবের ওপর ভর করে। যেখানে ভরাট বন্ধে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বা নিরব ভূমিকা পালন করেছে। আর সেই অবস্থায় অসহায় ছিল পরিবেশ রক্ষার নামে কাজ করা সংগঠনগুলো।

আরও পড়ুনঃ  মোংলায় দিগরাজ ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ে আই সি টি ভবনের উদ্বোধন
কুমিল্লায় পুকুর-দিঘি ভরাট করে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন
কুমিল্লায় পুকুর-দিঘি ভরাট করে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন

নগরীতে পুকুর দিঘির মধ্যে ভরাট হয়েছে এমন উল্লেখযোগ্য তালিকায় রয়েছে-চকবাজার বাসটার্মিনাল পুকুর, ডিগাম্বরীতলার আজিজ মজুমদারের পুকুর, অমূল্য পুকুর, ঝাউতলার খ্রিষ্টান পুকুর, নজরুল এভিনিউ এলাকার ইন্দ্রকুমার সেনের পুকুর, ঠাকুরপাড়ার আমজাদ ভিলার সামনের পুকুর, কামিনী চন্দের পারিবারিক পুকুর, পাল পুকুর, জোড় পুকুর, মদিনা মসজিদের সামনের পুকুর, কাশেমুল উলুম মাদরাসার রাস্তার পশ্চিমের অনেক পুরনো পুকুর, রামমালা সড়কের পশ্চিম পার্শ্বের পুকুর, নিরোদা সুন্দরী স্কুলের সামনের পুকুর, শাসনগাছা বাসট্যান্ড বিরাটাকারপুকুর, মনোহরপুরের ক্ষিতীশ দত্তের পুকুর, ভিক্টোরিয়া কলেজের ব্যাঙ পুকুর, ডিগাম্বরীতলার পুকুর, অমূল্য দিঘি, মোগলটুলির লালা দিঘি, ছোটরা রেজিষ্ট্রি অফিসের পেছনের দিঘি, মনোহরপুর লাকসাম রোডের কাসেমুল উলুম মাদরাসার দিঘি, চর্থা ড্রাইভার সমিতির পুকুর, উত্তর চর্থার নূর বাড়ির পুকুর, মুরাদপুর জানু মিয়া মসজিদের পেছনের বিশাল জলাধার ও অহিদুন্নেছা প্রাইমারি স্কুলের দক্ষিণ পার্শ্বের পুকুর, সংরাইশ সাহাপাড়া সর্দার বাড়ির দিঘি, সংরাইশের চম্পা বেগমের পুকুর, সুজানগর খানেকা পুকুর, দক্ষিণচর্থা হাজী মাসুকের বাড়ির সামনের পুকুর, গর্জখোলার পূর্বপাড়ার পুকুর, হযরতপাড়ার ধোপা পুকুর, দ্বিতীয় মুরাদপুরের হাতির পুকুর, পাথুরিয়াপাড়ার লস্কর দিঘি, ছাতিপট্টির বাঙ্গরা বাড়ির পুকুর, কাপ্তানবাজার এলাকার কার্জন কুটির পুকুরসহ আরও অসংখ্য দিঘি পুকুর ভরাট করে প্লট বরাদ্দ ও ফ্ল্যাটবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।

সম্প্রতি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে নগরীর ২০ নং ওয়ার্ডের কাজীপাড়ার ২০০ বছরের একটি পুরোনো পুকুর। স্থানীয়দের কাছে পুকুরটি কাজীবাড়ির পুকুর বা কাজী পুকুর নামে পরিচিত। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ শতকের পুকুরটির অর্ধেক ভরাট হয়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃ  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০২৩টি ভবন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলি বলেন, ভরাটকারীরা যেন বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন।  নগরী ও আশ-পাশের এলাকায় পুকুর ও জলাশয় ভরাটের মহোৎসব চলছে।  সম্প্রতি আমরা ৪/৫ জনকে নোটিশ করেছি ভরাট বন্ধ করার জন্য।  এছাড়া একজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করেছি।  এসব ভরাট বন্ধ না হলে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।  এই বিষয়ে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। পুকুর-দিঘি ভরাট হচ্ছে এমন তথ্য বা অভিযোগ পেলে সাথে সাথেই আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু তথ্য বা অভিযোগ না পেলে তো আমাদের করার কিছু থাকেনা। ২০০ বছরের পুরোনো নগরীর কাজীপাড়ার কাজী বাড়ি পুকুরটি ভরাট করা নিয়ে তিনি বলেন- এ বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। এরপর ভরাটকারীদের ফোন করে বলেছি তা বন্ধ করতে। ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু বলেন, যেখান থেকেই অভিযোগ পাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।  অনেক সময় কাউন্সিলরদের পাঠাচ্ছি ভরাট বন্ধ করতে। আমরা সবাইকে সতর্ক করছি। এভাবে পুকুর ভরাট করার কোন সুযোগ নেই, এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রয়োজনে শিগগিরই এসব ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করবে সিটি করপোরেশন।

কুমিল্লার পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসন ও দায়িত্বশীলদের কাছে আমরা কঠোর পদক্ষেপ সবসময় প্রত্যাশা করি। কিন্তু গত কয়েক বছরে নগরীতে যেহারে পুকুর-দিঘী ভরাট হয়েছে সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। বর্তমানে যেসব দিঘি পুকুর ও জলাধার বিদ্যমান আছে তা সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনে নতুন করে পুকুর-দিঘি খননের উদ্যোগ নেয়া হলে ভবিষ্যতে কুমিল্লার মানুষ বিপর্যয়মুক্ত জীবন অতিবাহিত করতে পারবে।

আরও পড়ুনঃ  লক্ষ্মীপুরে প্রবাসীর নির্মাণাধীন ঘর ভাঙচুরের অভিযোগ

আনন্দবাজার/শাহী/আলাউদ্দিন

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন