শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাত নামলেই অশান্ত

রাত নামলেই অশান্ত

সময় যতই গড়াচ্ছে মানুষের মধ্যে টেনশন ততই বাড়ছে: রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে ক্যাম্পের সশস্ত্র গোষ্ঠী:  মেজর (অব.) ড. এস কে হাবিবুর রহমান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

উখিয়া টেকনাফের মানুষের দুর্ভোগ, দুর্যোগ ও অভিশাপের আরেক চরম আতংকের জনপদ রোহিঙ্গা ক্যাম্প। দিনের বেলায় সব ঠিক, সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা। মাদক, অস্ত্র, অপহরণ ও খুনোখুনির মতো ঘটনা এখন নিত্যদিনের। দিনের শান্ত শিবিরগুলো রাতে রুদ্র মুর্তি ধারণ করে। ভীতিকর এ পরিস্থিতিতে রাতের বেলায় চিত্র বদলে যায় পুরোপুরি। নিয়ন্ত্রণ চলে আরসা, আরএসও, আরএনও, জমিউতুল মুদারেসীন, আল ইসলাম, আল ইয়াকিন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম মুজাহিদ কমিটি ও আল ইনসানসহ ২৯টি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে উঠিয়া টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে। এর বাইরে বেশকিছু সন্ত্রাসী গড়ে তুলছে নিজস্ব ক্যাড়ার বাহিনী। এমনই ভয়ংকর তথ্য দিয়েছেন সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী।

গতকাল বুধবার ভোরে উখিয়া পালংখালী, বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১০ এফ ১৬ ব্লকে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা ঘরে ঢুকে এক যুবকের বুকে গুলি করে হত্যা করে। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। আগের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুখোশধারী ১০/১২ জনের সশস্ত্র বাহিনী ক্যাম্প ২ কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যার উদ্দেশ্য গুলি করে গুরুতর আহত করে সালাম নামের (৩৫) এক যুবককে। এর আগে মাত্র ১০ দিনের মাথায় আরো ৫ রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এদিকে উখিয়ার জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৫ এর সি ৯ ব্লকের দুগর্ম পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে হেডমাঝিসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও উত্তপ্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আসলে কার নির্দেশে হচ্ছে আর রাতের আঁধারে কারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে তা নিয়ে নতুন করে গুঞ্জন উঠেছে।

আরও পড়ুনঃ  ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২ মৃত্যু, হাসপাতালে ২৫৩

বাইরের দিক থেকে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদেরকে শান্ত মনে হলেও ক্যাম্পগুলোর ভেতরে রয়েছে অস্থির কার্যক্রলাপ। কয়েকটি পক্ষে এরইমধ্যে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ফলে কিছুদিন পরপরই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের খবর আসছে জাতীয়, স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদ্যুত সরবরাহ নেই। অন্যদিকে পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই। ফলে এসব কার্যক্রলাপের বেশিরভাগটাই থেকে যাচ্ছে অদৃশ্যে।

ক্যাম্পের ভেতরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতের বেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। এই সশস্ত্র গোষ্ঠী চায় না যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায়। শুধু তাই নয় দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোও চায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে অস্থির করে সরকারবিরোধী নাশকতার মাধ্যমে সরকারের পতন। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটাতে চায় একটি পক্ষ।

ক্যাম্পের ভেতরে বড় কয়েকটি সড়ক তৈরি করা হয়েছে যেগুলো ‘আর্মি রোড’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এসব রাস্তার মাধ্যমে সব জায়গায় পৌঁছনো যায় না। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে পৌঁছাতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। ফলে যে কোনো অপরাধ করে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। রাতের বেলায় এসব জায়গায় যেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপদ বোধ করেন না।

সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বোঝা গেল, এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ক্যাম্প দিনের বেলায় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করলেও রাতের বেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলে চলে যায়। সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত তারাই রাজত্ব করে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠী চায়না যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায়।

আরও পড়ুনঃ  কাউন্টারে যাত্রীর চাপ নেই

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) ড. এস কে হাবিবুর রহমান বলেন, দিন যত যাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ততই বাড়বে। এর মাধ্যমে সেই সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেবার পর সে গোষ্ঠী অনেক রোহিঙ্গাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে যাতে তারা ফিরে যেতে রাজি না নয়। স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।

প্রশাসনের দুশ্চিন্তা

কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত কর্মকর্তা, পুলিশ এবং বিজিবি অনেকেই আশংকা প্রকাশ করেন যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে জঙ্গি তৎপরতা তৈরি হতে পারে। এর একটি বড় যুক্তি ছিল, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো হয়তো তাদের সদস্য সংগ্রহের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে টার্গেট করে নিয়েছে। রোহিঙ্গা জঙ্গি ও বাংলাদেশের জঙ্গিদের টার্গেট প্রায় এক। তারা চায় অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে ভিন্ন কৌশলে ক্ষমতার পট পরিবর্তন করা।

তাছাড়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠুক মিয়ানমার বাহিনীর ওপর। সেজন্য তারা বাংলাদেশের ভূমিকে ব্যবহার করতে চায়। আর বাংলাদেশি জঙ্গিদের উদ্দেশ্য রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সঙ্গে নিয়ে সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করা। স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন, আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।এই আশংকা এখনো তারা লালন করেন। বিষয়গুলো মাথায় রেখে শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশে সরকার।

স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আগামী কয়েক বছর পর রোহিঙ্গারাই ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এখান থেকে টাকা আয় করে নিজেদের সংগঠন চালানোর জন্য খরচ করে তারা।

আরও পড়ুনঃ  অটিস্টিক বাচ্চাদের সাঁতার প্রশিক্ষণ উদ্বোধন

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের ‘নিজস্ব দ্বন্দ্বের’ কারণে খুনোখুনিগুলো হচ্ছে। যার প্রভাব কক্সবাজারের আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও পড়ছে। সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে টেনশন তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সংকট

এতদিন জাতিসংঘ প্রস্তাবে ভোট দেয়নি ভারত, বিপক্ষে ছিল চীন। বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। চীন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সাড়া দিয়েছে। তাই কিছুটা হলেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়েছে। মিয়ানমার প্রত্যাবাসনে সম্পত্তি দিয়েছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের পূর্বে জুড়ে দিয়েছে পাঁচ শর্ত। এবার শর্তের বেড়াজালে আটকে যেতে পারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।

এমনটা মনে করেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জাতীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আতাউল্লাহ খাঁন। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ক্যাম্পের ভেতরে একটি অংশ আছে যাদের ‘কাফের’ বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সন্দেহ করে অপরপক্ষ। এসব ব্যক্তি এখনো ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের তথ্য দেয় বলে তাদের প্রতিপক্ষের অভিযোগ।

ক্যাম্পের ভেতরেই একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে যারা তাদের দৃষ্টিতে ‘কাফের’ চিহ্নিত করার কাজ করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা এসব হত্যা নিয়ে চিন্তিত নয়। তাদের বক্তব্য, ‘যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই মোনাফেক। কোনো ভালো মানুষকে হত্যা করা হয়নি। পুলিশ বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে গত পাঁচ বছরে অন্তত ১২৪টি খুন হয়েছে। যার বেশকিছু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সূত্রগুলো বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীর কথা না শুনলে পরিণতি হয় ভয়াবহ।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন