শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মহামন্দার মুখে বিশ্ব

খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ঝুঁকি

খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ঝুঁকি

মহামন্দার আশঙ্কা করছে বিশ্ব। বাংলাদেশও তার বাইরে নেই। যার যতটুকু জমি আছে তাতে সাধ্যমত চাষ করতে প্রতিনিয়ত আহ্বান জানিয়ে চলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক মহামন্দার কারণও একাধিকবার উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই আশঙ্কার পালে হাওয়া লাগিয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি-ডব্লিউএফওসহ বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাসে খাদ্য সংকটের চরম বার্তা দিচ্ছে।

এফএওর হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা বিশ্বের ৪৫টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)’ গবেষণায় বলা হয়েছে, ডলার সংকট, জ্বালানি, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য, ইউক্রেন, কোভিড এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটসহ ৭টি সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিশ্ব মহামন্দার মুখোমুখি বাংলাদেশকে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এসব সংকটের মধ্যে ডলার, জ্বালানি, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকটের কারণে অন্যান্য সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সার্বিকভাবে ওই সাত সংকট আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস দেখা গেছে। বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি ঐতিহাসিকভাবেই ঊর্ধ্বগতিতে রয়েছে। বিভিন্ন দেশে প্রবৃদ্ধি হয় নিচে অথবা নেতিবাচক দিকে রয়েছে। আমরাও সেই প্রভাব অনুভব করছি। এই সংকটটি চললাম ও ঘনীভূত হচ্ছে।

ড. ফাহমিদা বলেন, মূল্যস্ফীতি লাগামগীন। আন্তর্জাতিক পণ্যের দামও বেশি। আবার দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি। খাদ্য সংকটেরও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এফএও পৃথিবীর ৪৫টি দেশ খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে বলে জানিয়েছে, এই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  চাকরিপ্রার্থীদের বয়সে ২১ মাসের ছাড় দিতে প্রস্তাব যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী কাছে

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক্রপ প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আছে ৯টি দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশসহ তিনটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার। বাংলাদেশে চলতি বছরের মে মাসে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় বোরো ধানসহ ব্যাপক ফসলহানির শিকারের বিষয়টি উঠে এসছে। এফএওর হিসাবে ওই সময়ের বন্যায় অন্তত ৭২ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে থাকা ১০ লাখ রোহিঙ্গা খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) সম্প্রতি প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ ‘কমোডিটি মার্কেট আউটলুক’ অনুযায়ী বিশ্ববাজারে গত সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন ধরনের সারের দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম কমলেও খাদ্য ও কৃষিপণ্যের দাম আগের দু’মাসের মতোই রয়েছে।

আগস্টে ডব্লিউএফপি পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে গত ১৩ অক্টোবর ‘বাংলাদেশ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি মনিটরিং রিপোর্ট’ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২২ শতাংশ পরিবার মাঝারিমানের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে। নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ৪২ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। এ ধরনের পরিবারে পুষ্টিরও অবনতি হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত আগস্টে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছে। সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রামে মূল্যস্ফীতি শহরের চেয়ে বেশি।

আরও পড়ুনঃ  কম খরচে লাভ বেশি জৈবসারে

সম্প্রতি কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) এ বছর ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ থেকে ৮৪তম স্থানে নেমে এসেছে। এই সূচকেও বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘মাঝারি মাত্রার’, যা ‘গুরুতর’ অবস্থার কাছাকাছি। সূচক ২০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে থাকলে পরিস্থিতি ‘গুরুতর’। বাংলাদেশের সূচক ১৯ দশমিক ৬, যা ‘গুরুতর’ অবস্থার সামান্য নিচে।

সিপিডি’র গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরে যারা বসবাস করছেন তাদের খাদ্যপণ্যের তালিকার ১৯টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য রয়েছে। যা মানুষের ভোগের মধ্যে সব থাকে। ঢাকায় ৪ সদস্যের একটি পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় সব খাদ্যসহ সার্বিক খরচ ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছিল ১৭ হাজার ৫৩০ টাকা, যা ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবরের খাদ্যপণ্যের মূল্য বিবেচনায় খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৪২১ টাকা।

অন্যদিকে, যদি মাছ ও মাংস বাদ দিয়ে কম্প্রোমাইজ ডায়েট হিসেবে ৪ সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। যা ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ছিল ৬ হাজার ৫৪১ টাকা। খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর আমদানি শুল্কের হার কমাতে পারলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমে আসতো বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। মাছ-মাংস না খেয়েও ঢাকা শহরের ৪ সদস্যের এক পরিবারকে মাসে এখন খাবার কিনতে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। আর মাছ-মাংস খেলে ওই পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি চলতি অক্টোবর মাসের হিসাব। গত পৌনে চার বছরে খাবার কেনায় ওই সব পরিবারের খাবার খরচ  ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।

আরও পড়ুনঃ  আমদানি-রফতানিতে বাড়লো গতি

সিপিডি আরও বলছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি, আর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ছে। সিপিডি দেখিয়েছে, এত কম হারে মজুরি বাড়লে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকেরা মাছ-মাংস না খেয়েও সংসার চালাতে পারবেন না। তাঁদের ন্যূনতম মজুরি চেয়ে খাবার খরচের বেশি। এ তালিকায় আছে তৈরি পোশাক, হোটেল-রেস্তোরাঁ, প্রসাধনী, দরজি, বেকারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, প্লাস্টিক, চালকল, চামড়া ও পাদুকা খাতের শ্রমিকেরা।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য একটি রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যপণ্য কেনায় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, নিজের মজুত নিশ্চিত না করে কোনো দেশ পণ্য রপ্তানি করতে চাইবে না। তাই ভবিষ্যতে ডলার থাকলেও বিশ্ববাজারে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য নাও থাকতে পারে।

সিপিডি বলছে, এ সংকট মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগগুলো সঠিক, কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২৩ সালেও এ সংকট থেকে মুক্তি পাব না। বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক বছরের মধ্যে পরিত্রাণ পাব-এটা আশা করা যায় না।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন