শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডেঙ্গু সংক্রমণ--

আতঙ্ক নয় সতর্কতা

আতঙ্ক নয় সতর্কতা

ডেঙ্গু এডিস মশা বাহিত একটি রোগ। এই রোগটি গ্রীষ্মকালীন সময়ে বেশি দেখা যায়। সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। সাধারণত দুই থেকে সাতদিনের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষয়ী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এ সময় রক্তপাত হয়, রক্ত অণুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরে আবার ডেঙ্গুর এই সংক্রমণ সারাদেশের মানুষের জন্য নতুন ভীতিকর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১৬ হাজার ৭২৭ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১৪ হাজার ৫১৩ জন। এর মধ্যে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই সবচেয়ে বেশি ৮ হাজার ১৮১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সর্বাধিক ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে এ মাসে। ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকা শহরের বাসিন্দারা। তবে সারা দেশের কোথাও বেশি কোথাও কম ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিল মাসে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন, জুন মাসে ৭৩৭ জন, জুলাই মাসে ১ হাজার ৫৭১ জন এবং অগাস্ট মাসে ৩ হাজার ৫২১ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর এইডিশ মশাবাহী এ ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১০৫ জন।

আরও পড়ুনঃ  তিস্তায় পানি বৃদ্ধি, বন্যার শঙ্কা

গতবছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে চলতি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার ৯৫ জন। এদের মধ্যে অগাস্ট মাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এই এক মাসে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৭ হাজার ৪৩৫ জন। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪২ জন মানুষ তাদের প্রাণ হারিয়েছেন।

সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক জরিপের মাধ্যমে জানিয়েছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল কোভিড মহামারি হানা দেওয়ার ঠিক আগের বছর ২০১৯ সালে। সে বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিল শিশু, শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী।

বিগত সময়ে ডেঙ্গু পরিস্থিত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ঐ আটবছরে কখনোই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়ায়নি। ২০১৫ সাল থেকে রোগটির প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। ২০১৭ সালে কিছুটা কমে ২০১৮ সালে আবার বেড়ে যায়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় বসবাস করে। এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আমেরিকা, আফ্রিকা ও ক্যারিবিয় অঞ্চলের প্রায় ১০০টি দেশে এ রোগের বিস্তার রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি বছর ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। যার মধ্যে ৫ লাখ মানুষ হেমোরেজিক জ্বরে ভোগেন আর কমপক্ষে ২২ হাজার মানুষ মারা যান। যাদের মধ্যে একটি বড় অংশই শিশু।

আরও পড়ুনঃ  শ্বাসকষ্ট, সর্দি-জ্বর নিয়ে কুষ্টিয়ায় একজনের মৃত্যু

সারাদেশের তুলনায় ঢাকায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। এর বড় কারণ জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার কারণে ডেঙ্গুর লার্ভা সৃষ্টি হয়। নগরীতে যতগুলো প্রাকৃতিক খাল আছে তার অনেকাংশ দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারছে না। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্নয়হীনতা এ সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রেগুলেটর ও স্লুইসগেট নষ্ট হয়ে যাওয়া ও সঠিকভাবে পরিচালনা না করার কারণে ধীরগতিতে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান ২০১৫-এ মোট ৪৭টি খালের কথা উল্লেখ আছে। এ খালগুলো উদ্ধার করতে হবে এবং এর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ময়লা-আবর্জনা যাতে নর্দমা ও প্রাকৃতিক খালে ভরাট হতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। বর্ষা মৌসুমের আগেই নর্দমা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। নর্দমা নির্মাণ, মেরামত ও খননের কাজ শুকনো মৌসুমের মধ্যেই করা জরুরি।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে। তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন, কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  নিরাপদ খাদ্যের জন্য বড় লড়াই

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন