শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আমান চাচার দই--

খেয়ে দেখেছেন কি?

খেয়ে দেখেছেন কি?
  • দুই যুগ পার করেছে কালিগঞ্জের আমান দই ঘরের বিখ্যাত এ দই

গ্রামীণ জনপদের ছোট্ট একটি বাজার টেকমানিকপুর। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে বাজারটির অবস্থান। এ বাজারে টিনের বেড়ায় দু’চালা টিনের টং দোকানটি পঞ্চাশোর্ধ আমান সরকারের দইয়ের দোকান। যা স্থানীয়ভাবে সবার কাছে ‘দই ঘর’ হিসেবেই পরিচিত। দোকানের সামনে সবার জন্য বসার জায়গা রয়েছে। আশপাশের তিন সিটি কর্পোরেশনের (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর) মানুষ দই ঘরে আসেন দইয়ের স্বাদ নিতে। তারা খেয়েও যান আবার সঙ্গে করে পরিবার-পরিজনের জন্য নিয়েও যান।

দই ঘরে প্রতিদিন ঘরে ১১০ থেকে ১২০ কেজি দুধের দই বিক্রি হয়। তবে কোনো উৎসব হলে সেই বিক্রি বড়ে দ্বিগুণ হয়। আর এ দই ঘরে দইয়ের বিশেষ্যত্ব হলো এখানে কাচের গ্লাসে দই বিক্রি হয়। তবে প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাসেও দই ঘরের কিছু দই তৈরি হয়। যারা দই ঘরে এসে দইয়ের তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরেন তারা আবার ওই প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাসের দই বাড়ির জন্য নিয়ে যায়। এখানে মাটির তৈরি পাতিলেও দই বিক্রি হয়। ১ কেজি ৪০০ গ্রাম দই পাতিলসহ দুই কেজি ওজনের ওই দইয়ের মূল্য মাত্র ২৫০ টাকা। এক সময় একই ওজনের পাতিলে মূল্য ২০০ টাকা হলেও বর্তমানে গো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুধের দাম বেড়ে গেছে। আর বেশি দামে দুধ ক্রয় করায় দই ঘরের দইয়ের মূল্যও বেড়ে গেছে। দই ঘরের কাচের গ্লাসের দই ২০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন প্রতি গ্লাস (কাচ ও প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম) দই বিক্রি হয় ২৫ টাকায়।   

আরও পড়ুনঃ  স্বরূপকাঠিতে দুইশো পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী দিল এনজিও আশা

দই বলতে প্রথমে আমরা দেশের বগুড়ার দইয়ের কথাই চিন্তা করি। শুধু দেশে না, বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই বিদেশি মানুষ পর্যন্ত জানে। তবে বিভিন্ন জেলায়ও রয়েছে দইয়ের ঐতিহ্য। তেমনি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার টেকমানিকপুরের দই ঘরও একটি ঐতিহ্য। এক সময় স্থানীয় কোনো বাড়িতে বিয়ে বা অন্য কোনো আয়োজন হলেই নিজেরা দই তৈরি করতো। তবে, বর্তমানে আরাম প্রিয় মানুষ এখন আর বাড়তি জামেলা করেননা। তাই উৎসবের যে কোনো অনুষ্ঠানে দই তো থাকতেই হবে। যে কারণে স্থানীয় মানুষের ভরসার জায়গা এ দই ঘর। বিয়ের অনুষ্ঠান বা জন্মদিন অথবা অতিথি আপপ্যায়ন হয় এ দই ঘরের দই দিয়ে। তবে বর্তমানে আমান সরকারের দেখা দেখি কালীগঞ্জে অনেকেই এ দই ব্যবসা করছেন এবং স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে আমান সরকার ৩ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক। ইতিমধ্যে ২ মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেও এক মেয়ে পড়ছে ১০ম শ্রেণিতে। আর একমাত্র ছেলে জেএসসি’র পর আর লেখাপড়া করেননি। এখন বাবার সঙ্গে দই ঘরের ব্যবসায় সহযোগীতা করছেন। তবে আমান সরকারের দই ঘরে শুধু দই না দইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় কোমল পানীয়, চা, রুটি, কলা, বিস্কুট, চিপসও বিক্রি হয়।

দই ঘরের ব্যাপারে কথা হয় স্থানীয় দুই ইজিবাইক চালক আরিফ হোসেন ও সাইফুর রহমানের সঙ্গে। তারা জানান, প্রতিদিন ঢাকা, নারায়গঞ্জ ও গাজীপুর থেকে অনেক মানুষ এ দই ঘরে দই খেতে আসেন। অনেকে দোকানটি না চেনার কারণে তারা ইজিবাইকে করে আমান সরকারের দইয়ের দোকানে আসেন।

আরও পড়ুনঃ  'আওয়ামীলীগ সরকার মদিনা সনদের বাহিরে কোন কাজ করে না'

ঢাকার রামপুরায় বোলিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ত্রিশোর্ধ কাউছার আহমেদ। তিনি জানান, ঈদের ছুটিতে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। মানিকপুরের দই ঘরের কথা শুনেছেন এবং গুগলেও এ দই ঘরের নাম শুনে এখানে দই খাওয়ার জন্য ছুটে এসেছেন। প্রথমে এক গ্লাস খেয়ে ভালো লাগায় পরে আরো এক গ্লাস করে খান তারা। কাচের গ্লাসের দই খেতে সত্যি অসাধারণ।

একই প্রতিষ্ঠানে নেত্রকোনায় কাজ করেন ত্রিশোর্ধ সুমন আরিফুল। তিনি জানান, সময় হলেই এখানে আমান চাচার দই ঘরের দই খেতে আসি। একই কথা বলেন ওই প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্মকর্তা ত্রিশোর্ধ ওবাইদুল কবির পরান। তবে তিনি বাড়ির জন্য দুই কেজি ওজনের দুটি মাটির পাতিল কিনেছেন বাড়ির জন্য। 

গাজীপুর মহানগরীর বোর্ড বাজার এলাকায় ফ্লাইউডের ব্যবসা করেন মনির হোসেন (৩৯)। তিনি জানান, ঈদে খানাপিনা অনেক বেশি হয়। তাই খাবার পর দই হলে মন্দ হয় না। তাই দই ঘরে কাচের গ্লাসের ঠান্ডা দই খেতে  এসেছেন। তবে খাওয়া শেষে বাড়ির জন্য নিয়েও গেছেন বলেও জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার চিটাগাং রোডের একই ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে কাজ করেন জেমস সুমন (৩৮)। তিনি জানান, ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। আর বাড়িতে আসলেই টেকমানিকপুরে বন্ধু-বান্ধুবদের নিয়ে চলে আসেন দই খেতে। আমান কাকার দই খুবই সুস্বাদু।

দই ঘরের সত্ত্বাধিকারি আমান সরকার বলেন, ১৯৯৭ সালের দিকে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে দই তৈরি করে বাজারে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতাম। পরে আস্তে আস্তে এ দইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় বাড়তে থাকে আমার আয়োজনও। প্রায় ২৪ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে দই বিক্রি করে পরিবার পরিজন নিয়ে চলছি। এখন এ দই ঘরের নাম শুনে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটির মানুষসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে এসে দই খেয়ে যায় এবং বাড়ির জন্য নিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার ফোন করেও দিয়েও অর্ডার করেন।

আরও পড়ুনঃ  আজ থেকে বন্ধ গণপরিবহন

তিনি আরও বলেন, দই তৈরি করতে দুধ এবং চিনি কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। দুধ এবং চিনি একটি বড় পাতিলে বিরামহীন ৬ ঘণ্টা তেঁতুলের খড়ি দিয়ে জাল করতে হয়। এর পর জালকৃত দুধ কাচের বা প্লাস্টিকের গ্লাস, মাটির তৈরি পাতিলে রাখতে হয় এবং আগের তৈরি দইয়ের কিছু অংশ দিতে হয়। পরে সেই গ্লাস বা পাতিলে বাঁশের তৈরি ঢাকনা ভিতরে হালকা তাপমাত্রা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। এভাবে ৮ ঘণ্টা ঢেকে রাখার পর দুধ জমে তৈরি হয় সুস্বাদু দই।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন