শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পর্যটন মানচিত্রের বদল

পর্যটন মানচিত্রের বদল

প্রতীক্ষা শেষ। সর্ব সাধারণের জন্য আজ উন্মুক্ত হচ্ছে সর্বনাশা পদ্মার বুকে নির্মিত স্বপ্নের সেতু। দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এ সেতু। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। পাল্টে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার দৃশ্যপট। ঢাকার সঙ্গে সহজ যাতায়াত প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ। গতি পাবে নগরায়ন। কৃষিতে আসবে নতুন বিপ্লব। বাড়বে কর্মসংস্থান। বিকশিত হবে পর্যটন। পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটির বেশি মানুষ।

দেশের পর্যটন মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু। খুলনাকে হটিয়ে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হবে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। পর্যটক আগমনের দিক থেকে কক্সবাজারকেও চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে কুয়াকাটা। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাড় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক পদ্মার দুই পাড়ে নান্দনিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ঘুরতে যায়। মাওয়া ও শরীয়তপুর প্রান্তে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানাবিধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট জাজিরায় তাঁতপল্লী প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান ও খ্যাতনামা দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান এসব এলাকায় বিনিয়োগ করছে।

বাংলাদেশে তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে তন্মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ ও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এই দুইটি হেরিটেজ দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। তবে ওই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক পর্যটকদের পছন্দের পর্যটন কেন্দ্র হওয়া স্বত্বেও ভ্রমণে আগ্রহ ছিল কম। পদ্মা সেতুর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণগুলোতে ভ্রমণে আগ্রহ বাড়বে।

ফেরিবিহীন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের পণ্য পরিবহনসহ সহজে আসা যাওয়ার সুযোগ দেশের এবং দক্ষিণাঞ্চলবাসীর বড় প্রাপ্তির প্রতিফলন। পদ্মা সেতুকে ঘিরে কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মধ্যে রোমাঞ্চ বয়ে যাচ্ছে। পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীসহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষসহ সবার মুখেই এখন একটিই নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মুহূর্ত উপভোগ করতে ২৫ জুন কুয়াকাটাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে কয়েক লাখ মানুষ যাবে পদ্মার পাড়ে।

আরও পড়ুনঃ  ভোলায় নেই কাঙ্খিত ইলিশ

দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, ভাসমান পেয়ারা বাজার, ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর, কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট, খান জাহান আলী সেতু, খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর, জাতিসংঘ পার্ক, দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মাজার, রূপসা নদী, শহীদ হাদিস পার্ক, খানজাহান আলী কর্তৃক খননকৃত বড়দীঘি, খুলনা শিপইয়ার্ড, গল্লামারী স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমি, জাহানাবাদ বনবিলাস চিড়িয়াখানা ও শিশুপার্ক, পিঠাভোগ, প্রেম কানন বকুলতলা, মংলা পোর্ট, রাড়ুলী, রেলস্টেশনের কাছে মিস্টার চার্লির কুঠিবাড়ি, সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক ও অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণগুলোর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

ঢাকা থেকে আগে যেখানে কুয়াকাটায় আসতে যেতে ১৩টি ফেরি পার হতে হতো। সময় লাগতো ১৪-১৫ ঘণ্টা। সেখানে এখন ৫-৬ ঘণ্টায় কুয়াকাটা আসা যাওয়া করতে পারবেন। ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন অভাবনীয় সুযোগ আসবে তা কখনও ভাবেনি কুয়াকাটা তথা পটুয়াখালী উপকূলীয় এলাকাবাসী।

পর্যটকেরা কুয়াকাটা সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং খুব কম সময়ে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট-কচিখালী, কটকা সৈকত, জামতলা সী-বিচ, সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে জেগে ওঠা দ্বীপ পক্ষীর চর, ডিমের চর ঘুরে দেখার অপার সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। অন্যদিকে কুয়াকাটার গা ঘেঁষে অবস্থিত ফাতরার চর, লাল কাকড়ার চর, শুঁটকি পল্লী, লালদিয়ার চর, চর বিজয়, ফকিরহাট, সোনার চর, ক্র্যাব আইল্যান্ড। একটি স্পট থেকে আরেকটি স্পট নান্দনিক এছাড়াও রয়েছে ভিন্ন রকম জীব-বৈচিত্র্যর সমারোহ।

পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট ট্রেন চালু করার কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে যা দেশি ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

আরও পড়ুনঃ  '২০২২ সালের জুনে চালু হবে পদ্মা সেতু'

উপকূলীয় জেলা ছুঁয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পায়রা-মংলা হয়ে বেনাপোলকে সংযুক্ত করা হবে অদূর ভবিষ্যতে। অর্থনৈতিক এই মহাসড়ক পর্যটনকেও দারুণভাবে নাড়িয়ে দেবে। বিভিন্ন অংশে মহাসড়কের কাজ এগিয়ে চলছে, শুধু ভোলায় তেঁতুলিয়া নদীতে ব্রিজ করা হলে চট্টগ্রাম থেকে পায়রা কিংবা বেনাপোল যেতে হলে ঢাকা ঘুরে যেতে হবে না। সোজা চলে যেতে পারবেন পর্যটকরা।

পর্যটন খাতে বড় বড় বিনিয়োগকারী ইউনিক গ্রুপ, ইউএস বাংলাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানের চেইন হোটেল গড়ে তুলতে ক্রয়কৃত জমিতে কাজ চলমান রেখেছে। সেতুকেন্দ্রিক পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা তাদের নির্মাণাধীন অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ করছেন। নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনায় রয়েছে অগণিত আবাসন ব্যবসায়ী। কুয়াকাটায় সর্ব্বোচ্চ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেঞ্চুরি রিয়েল অ্যাস্টেট কোম্পনি থেমে নেই। আগাম প্রস্তুতি নিতে তাদের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। হু হু করে জমির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ফেরি পারাপারে বিলম্বের জন্য লোকসান গুণতে হবে না এখন আর ব্যবসায়ীদের। ন্যায্যমূল্য পাবেন জেলে ও কৃষকরা। পরিবহন সেক্টরেও ফিরে আসবে সুদিন। চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও অকল্পনীয় পরিবর্তন আনবে। বেকারত্ব দূর হবে। কর্মসংস্থান হবে এখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষের এমনটাই মনে করেন রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনরা। অন্যদিকে পায়রা বন্দর ও পায়রা তাপ বিদুৎকেন্দ্রের পণ্য পরিবহন সহজ হবে। বাড়বে বন্দরকেন্দ্রিক বিনিযোগকারীর সংখ্যা।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন