শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাবার-বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট

খাবার-বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট
  • নতুন করে বিভিন্ন উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত
  • জেলায় পানিবন্দি ৩ লাখ ছাড়িয়েছে
  • গো খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট
  • আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরে পানি

মৌলভীবাজারের আঞ্চলিক মহাসড়ক ভেঙ্গে কুশিয়ারার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। পাশাপাশি বাড়ছে হাকালুকি, কাউয়া দিঘী আর হাইল হাওরের পানিও। প্রধান প্রধান হাওরের পানি বেড়ে নতুন করে কুলাউড়া জুড়ী, বড়লেখা, রাজনগর, মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অন্তত ২৫টি ইউনিয়নে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পুরো জেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে।

অন্যদিকে, বন্যা কবলিত এলাকায় সরকারি ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। এমনটাই ভাষ্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। ফলে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ৩ লক্ষাধিক পানিবন্দি মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গো-চারণ ভূমি তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গো খাদ্যের সংকট।

সরেজমিনে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গেলে এই প্রতিবেদকের কথা হয় ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্ধাদের সাথে। তারা জানান -বুধবার বিকালে ইউনিয়নের হামরকোনা নামক স্থানে ঢাকা সিলেট পুরাতন মহাসড়কে বিশাল ভাঙ্গন দেখা যায়। এই ভাঙ্গন দিয়ে প্রবল বেগে কুশিয়ারা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। স্থানটি সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মিলনস্থল হওয়ায় কুশিয়ারা নদীর পানি খলিলপুর ইউনিয়ন হয়ে আবার হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় যাচ্ছে।

খলিলপুর ইউনিয়নের স্থানীয়রা জানান, ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম, শেরপুর মুক্তিনগর (নতুনবস্থি), হামরকোণা এই ৪টি গ্রামের অন্তত হাজার খানেক পরিবার পানিবন্দি আছেন।

মৌলভীবাজার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়া উদ্দিন জানান, শেরপুর এলাকায় অনেক স্থানে কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে এবং অভার ফ্লো করে খলিলপুর ইউনিয়নে ঢাকা সিলেট পুরাতন সড়কের ভেতরে পানি জমে ছিল। এই পানির বেগে বুধবার বিকেলে খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা নামক স্থানে ঢাকা সিলেট পুরাতন মহাসড়কে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এখন অন্তত ৬০ ফুট বিস্তৃত হয়েছে। তিনি আরও জানান, এই ভাঙ্গন যাতে আর না বাড়ে সেজন্য সড়ক বিভাগের লোকজন চটের বস্থায় মাটি ভরে দুই পাশে দিচ্ছেন।

আরও পড়ুনঃ  গরুচোর আতঙ্কে কৃষক

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা রহমান বাঁধন জানান, শেরপুর এলাকায় সড়ক বিভাগের পুরাতন রাস্থা ভেঙ্গে কুশিয়ারা নদীর পানি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দিকে যাচ্ছে। ফলে হাইল হাওরের পানি বেড়ে আমতৈল, কনকপুর, খলিলপুর ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে । এ সময়, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সদর উপজেলায় ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

কামালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আপ্পান আলী জানান, মৌলভীবাজারে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরও ৩২টি ঘরে পানি উঠেছে। এসব ঘরের লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সদর উপজেলায় মুজিব বর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরে পানি উঠেছে বলেও যুক্ত করেন।

কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, হাকালুকি হাওরের মধ্যবর্তী এই ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি এখনো বাড়ছে। নলকূপগুলো তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানীয় তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি আরও জানান, তার ইউনিয়নের বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হলেও অনেক অসচেতন লোক এগুলো দিয়ে পানি খেতে চায় না। তারা দূষিত পানি পান করে পানি বাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

বড়লেখার উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান জানান, ১০টির মধ্যে ৯ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বেশি আক্রান্ত ৭ নম্বর তালিমপুর ইউনিয়ন। ইউনিয়নের ৪০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকটও আছে। এখন পর্যন্ত ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ছাড়া আর কিছু দেওয়া হয়নি। তবে সরকারিভাবে ৩ টন চাল বরাদ্দ করা হলেও ইউনিয়নের জন্য অন্তত ৫০ টন চালের প্রয়োজন বলেও যুক্ত করেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  শিক্ষাবৃত্তি পেলো মধ্যপাড়া খনি শ্রমিক সন্তানরা

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক মুহাম্মদ সামছুদ্দিন জানান, মৌলভীবাজার জেলার ৭ উপজেলায় ১১ হাজার ১৭১ হেক্টর জমির নতুন আউশ ধান, ৩৬২ হেক্টর জমির বোনা আমন এবং ৮শ হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দেড় কোটি টাকার উপরে হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দপ্তরের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. এ জেড এম ওয়াহিদুজ্জামান জানান, ৭ উপজেলার প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী এই বিভাগের ক্ষয়ক্ষতি ১ কোটি ১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। এ সময় ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পাওে বলেও যুক্ত করেন তিনি।

কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা ফেরদৌস জানান, কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওর এলাকায় ভুকশিমইল, বরমচাল, ব্রাহ্মণবাজার, ভাটেরা, জয়চন্ডী কাদিপুর, কুলাউড়া পৌরসভা ও সদর ইউনিয়নের বন্যা কবলিত এলাকায় শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন জর সর্দি কাশি ও পেটের সমস্যায় ভুগছেন। আমরা তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছি।

মৌলভীবাজার জেলার সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দীন মুর্শেদ জানান, বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের ৭৫ টি মেডিকেল টিম মাঠে কাজে নেমেছে। তারা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, ৭ উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের ৪০ হাজার পরিবার বন্যা কবলিত হয়েছে। বন্যায় ৩ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি ১ হাজার ৩০ টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, মৌলভীবাজারে বন্যা কবলিত মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৪৪০ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ১০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। এ সময় ত্রান বিতরণে কোন গাফিলতি পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ্য করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন