শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাছশূন্য হচ্ছে মুক্ত জলাশয়

মাছশূন্য হচ্ছে মুক্ত জলাশয়

মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থান দখল করেছে। এখাতে বিপুল সাফল্যও অর্জন করেছে। পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বহু প্রজাতির মাছচাষে বিপ্লব ঘটছে। তবে দিন দিন পানি দূষণের বিপদ বাড়ায় উন্মুক্ত জলাশয় হুমকিতে পড়েছে। বিশেষত কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয়ের মিঠা পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। আর বিষাক্ত পানির কারণে দেশীয় মাছ আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে।

এছাড়া বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্টজাল দিয়ে মা মাছ নিধণের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। একটি অসাধু চক্র মাছে ডিম ও পেনা মাছ ধরেও দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি করছে। বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ফলে দেশীয় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। দেশের মধ্যভাগের যুমনা তীরবর্তী জেলা টাঙ্গাইলের নদ-নদীতেও মাছ কমে যাচ্ছে। ফলে দিন দিন পেশা ছাড়ছেন এ অঞ্চলের জেলেরা। দারিদ্র জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে অর্থাভাবে অন্য পেশায়ও যেতে পারছেন না। ফলে অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছগুলো এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। দেশি সরপুটি, গজার, জেব্রা, এলং, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, বউরাণী, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারা বাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৫০টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। হাট-বাজারে গেলেও দেশীয় মাছের দেখা মেলে না। পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড মাছে সয়লাব মাছের বাজার।

যেসব পুকুরে একসময় দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো, সেইসব পুকুরে এখন বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষ হচ্ছে । ফলে মিঠা পানির দেশীয় প্রজাতির মাছের স্থান দখল করেছে পুকুরে উৎপাদিত হাইব্রিড মাছ। বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় খামারে চাষ করা পাঙ্গাশ মাছ।

আরও পড়ুনঃ  করোনা উপসর্গে মৃত্যু, সিঁড়িতেই পড়ে রইল লাশ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, সেচ দিয়ে মাছ শিকার, মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচলে বাধাগ্রস্ত এবং অবাধে মৎস্য নিধনের কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মহাবিপন্ন, সঙ্কটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি। মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রাণী, পাঙ্গাশ, বামোশ, নাফতানি, চিতল, ও চাকা। সঙ্কটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়। বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালোবাউশ।

দেশে উন্মুক্ত জলাশয়ের আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ। তথ্য বলছে, বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যখাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থুল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৪ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রপ্তানি আয়ে মৎস্যখাতের শরিকানা শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খণ্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্যমোচনে এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্যখাতের উন্নয়ন অপরিহার্য।

বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে আছে পুকুর, মরা নদীর অংশ বা বাঁওড় ও উপকূলীয় চিংড়ি খামার। এর আয়তন ৫.২৮ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের ১১.৫৪ শতাংশ। আমাদের সমুদ্র তটরেখা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। মোট সামুদ্রিক জলসম্পদের আয়তন ১৬৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট জলসম্পদের ৭৮.৩৯ শতাংশ। এছাড়া দেশে অসংখ্য পুকুর রয়েছে, যার মোট জলভাগের আয়তন প্রায় ৩ লাখ ৫ হাজার ২৫ হেক্টর। জাতীয় পর্যায়ে প্রায় ৪৬ শতাংশ পুকুরে (পুকুরের মোট আয়তনের ৫২ শতাংশ) মাছচাষ হয়।

আরও পড়ুনঃ  দুর্গাপূজা উপলক্ষে গোপালগঞ্জ নিরাপত্তাজনিত সভ

দেশীয় মাছ কমে যাওয়ায় জেলেদের চলছে মানবেতর জীবন। তারা বলছেন, জালে ওহন আর মাছ পাই না। আগে নদীতে গেলেই মাছ পাইতাম। বেলা উঠার আগেই পাড়ার জেলেদের নিয়ে নদীতে যাইতাম। কতো সময় পালানে (পরিত্যাক্ত জমি) জাল বাইতাম। ঘণ্টাখানেক জাল বেয়ে দশটার আগেই বাজারে মাছ উঠাইতাম। কাওরে ভাগ ভাটওয়ারাও দিতে অইতো না। যা কামাইতাম ওতেই সংসার চইলা যাইতো। ওহন মাছ সব পালা। খোলা পানিতে চাইলেই মাছ পাই না। ওহন পালা মাছ মাইরা দিতে অয়। একদিন একজনের পুকুরে পালা মাছ মাইরা দিলে পরের দিন বেকার বইয়া থাকি।

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের জেলে ফনিন্দ্র রাজবংশী, লক্ষণ রাজবংশী, কানাই রাজবংশীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেল। ওদের মতো জেলেপাড়ার অনেকেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মা মাছ নিধন, কারেন্ট জালের ব্যবহার, কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ কারণে আগের তুলনায় জলাশয়ে মাছ অনেক কমে গেছে বলে মনে করছেন জেলা মৎস অফিসসহ এ অঞ্চলের জেলেরা।

কানাই রাজবংশী বলেন, এক সময় মাছ ধরতে গেলে মাছে নৌকা বোঝায় হয়ে যেতো। কিন্তু এখন আগের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরা যায় না। খাল-বিলে মাছ কমে যাওয়ায় অনেক জেলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। আগে খোলা নদীনালা থেকে স্বাধীনভাবে মাছে ধরে সংসার ভালোভাবেই চলে যেত। এখন মুক্ত নদ-নদীতে আগের মতো মাছ না থাকায় চাষ করা পুকুরে দিনমজুর হিসেবে মাছ ধরে দিতে হয়। এতে সপ্তাহে দু-একদিন এধরণের পুকুরে মাছ ধরার সুযোগ পেলেও বেশিরভাগ দিন কাটে বেকারে। মৎস সপ্তাহের সময় নানা পদক্ষেপে স্বপ্ন দেখালেও সারাবছর বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না এমন অভিযোগ জেলেদের।

আরও পড়ুনঃ  ভূমিদস্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে ভুক্তভোগীর সংবাদ সম্মেলন

জেলা মৎস্য অফিস জানায়, জেলায় ৪১ হাজার ৪৯৫টি পুকুর রয়েছে। এছাড়াও বিল ২৯৮টি, বাওড় ৩টি, পেন কালচার ৪টি, ৮টি নদী ও ১২৮টি খাল রয়েছে। এ এলাকায় মাছের চাহিদা ৭৩ হাজার মেট্রিক টন। মুক্তজলাশয়ে মাছ কমে যাওয়ায় বদ্ধজলাশয়ে মাছচাষ বাড়িয়ে মাছের চাহিদা পুরণ হচ্ছে না। বর্তমানে হাইব্রিড বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে এসব মাছ চাষের আগে পুকুর ও ডোবার পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোয় মাছ, শামুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এদিকে অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশীয় মাছের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। এছাড়া অতিমাত্রায় পুকুর সেচের কারণেও দেশীয় মাছ বিলুপ্তি হচ্ছে।

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমদাদুল হক বলেন, কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ কারণে আগের তুলনায় প্রাকৃতিক মাছ অনেক কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, দেশি মাছ সংরক্ষণে হ্যাচারি স্থাপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনেককেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যেখানে পানি কম থাকে সেখানে মৌসুমী মাছ চাষ করা হবে বলেও তিনি জানান।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে দেশে আমিষের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন মৎস্যসম্পদের পাশাপাশি জলজ সম্পদও বিলুপ্ত হতে পারে, ফলে প্রকৃতি হারাতে পারে ভারসাম্য। এজন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার রোধ করা, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ না ধরা, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ না করা, জলাশয় সংলগ্ন রাসায়নিক সারের ব্যবহার রোধ করাসহ প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন