রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্রীয় নথি বাংলায় কবে

রাষ্ট্রীয় নথি বাংলায় কবে

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এলো স্বাধীনতা। সৃষ্টি হলো নতুন দেশ। যে ভাষাকে কেন্দ্র করে এতো আয়োজন সেই ভাষাটি এখন উপেক্ষিত। সর্বস্তরে প্রচলনসহ দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাভাষার সর্বজনীনতা এখন পাইনি। আজও দেশের উচ্চশিক্ষা স্তরে, চিকিৎসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা তথা ইংরেজি ভাষা অনিবার্য। উচ্চশিক্ষা স্তরের বেশিরভাগ পাঠ্য-পুস্তকই বিদেশি ভাষায় লেখা। আজও অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষারই প্রাধান্য দেখা যায়। শুধু প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই মাতৃভাষার প্রচলন আর সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়, দাবি তোলা হয়। এরপর আর সেই উদ্যোগ তেমন গতি পায় না।

অথচ ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেছিলেন, ‘আজ থেকেই বাংলাদেশের দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। তারও আগে নির্বাচনে বিজয় পরবর্তী ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি কার্যালয়-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে।’

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এর দেড় যুগ পর ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করা হয়। এই আইনের প্রবর্তন ও কার্যকরী সংক্রান্ত ৩(১) ধারার ভাষ্য, ’এই আইন প্রবর্তনের পর দেশের সর্বত্র তথা সরকারি কার্যালয়, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’

আরও পড়ুনঃ  কৃষকের স্বপ্নে চোরের হানা

তবে এতসব আয়োজন, ঘোষণা এমনকি আইন প্রণয়নের পরও গত প্রায় ৫০ বছরেও দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হয়নি। এখনও দেশের উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা ও কারিগরি শিক্ষা চলছে ইংরেজি ভাষায়। পাঠ্য-পুস্তক বেশির ভাগই ইংরেজি ভাষায় লেখা। অথচ বাংলা একাডেমি সৃষ্টির অন্যতম কারণ ছিল বাংলায় পাঠ্য-পুস্তক তৈরি ও অনুবাদ করা। অথচ সেই বাংলা একাডেমিও সে পথে নেই। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন। তিনি বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে যান।

রাষ্ট্রের সর্বস্তরে আজো বাংলা কেন চালু হলো না, ভাষাসংগ্রামী ও গবেষক ডাক্তার আহমদ রফিককে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, এটি তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব-কর্তব্য। ভাষাসৈনিকরা এ নিয়ে আন্দোলন করেই যাচ্ছে। সকল স্তরে তো বাংলার প্রচলন হয়নি। ভাষা আন্দোলনের পরে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে যে সাফল্য এসেছিল তা ধরে রাখা যায়নি। আমরা ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা পেলেও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণাপত্রগুলো ইংরেজি ভাষায় প্রণয়ন করা হয়। সামান্য কিছু গবেষণা বাংলা ভাষায় হয়। মন্ত্রিদের উপস্থিতিতে অনেক সেমিনারই ইংরেজিতে। এমনকি রাষ্ট্রীয় নথি, পরিকল্পনা প্রধানত ইংরেজিতে করা হয়। এখানে দুটি ভাষা রাখা যেতে পারে। প্রথমে বাংলা সঙ্গে ইংরেজি।

এ ব্যাপারে ভাষাসৈনিক ড. জসীম উদ্দীন বলেন, আমরা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা বাংলা করতে দাবি জানাই কিন্তু নিজেদের দেশের সর্বস্তরে এটি প্রচলন করিনি। আমি নিজেও জাতিসংঘের দপ্তরে চাকরি করেছি। জুমার নামাজ চালু করে সেখানে খুতবাও দিয়েছি। সেসব বাংলা ভাষাতে ও ইংরেজিতে করেছি। দেশে কিন্তু হলো না। এমনকি ভাষাসৈনিকদের একটা তালিকা পর্যন্ত হলো না। অথচ ভাষাসৈনিকদের প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করা প্রয়োজন ছিল। কেননা, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ।

আরও পড়ুনঃ  পানিবন্দী পোস্ট অফিস

ভাষাসৈনিক ডাক্তার সাইদ হায়দার বলেন, ভাষা আন্দোলনের পরপরই আমি বাংলা ভাষাতে চিকিৎসাশাস্ত্রের বইপত্র প্রণয়ন করি। বাংলা একাডেমি থেকে এসব প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রথম সংস্করণ শেষ হলে পরবর্তীতে আর তা প্রকাশ করা হয়নি। প্রচুর পরিশ্রম করে বাংলা ভাষায় এসব প্রণয়ন করেছিলাম। আপনি চীনের দিকে তাকান তারা কি ইংরেজি বা ভিন্ন ভাষায় ডাক্তারি পড়ায়? তবে আমরা কেন এখনো পারছি না! আমাদের সদিচ্ছার অভাব আছে। রাষ্ট্রের কাজ এখন আর পিছিয়ে না থেকে মাতৃভাষা তথা বাংলায় সার্বিক বই-পুস্তক প্রণয়নে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা।

আদালতে বাংলা ভাষা
আইনজীবী ও বিচারালয়-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রয়াত বিচারপতি এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সর্বপ্রথম হাইকোর্টে বাংলায় আদেশ দেওয়া শুরু করেন। এরপর সাবেক বিচারপতিদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দেন। বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, চার নদী সংরক্ষণসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় বাংলা দেন।

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ২০১৩ সালে বাংলায় রায় লিখেছেন। তিনি বিভিন্ন মামলার ১৫ হাজার রায়-আদেশ ও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, আমি বিচারপতি থাকাকালে বাংলা ভাষায় রায় দিয়েছি। এটি কঠিন কিছু না। প্রত্যেকেই নিজ থেকে অনুভব করলেই এটি সম্ভব।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (বাংলাদেশ) প্রধান কৌশলী ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু বলেন, নিম্ন আদালতে বেশিরভাগ রায় বাংলায় দেয়া হয়। এটি উচ্চ আদালতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেয়া শুরু হয়েছে। পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা কঠিন কিছু নয়।

আরও পড়ুনঃ  ফুলবাড়ীতে বাল্যবিবাহ মুক্ত ইউনিয়ন ঘোষণা

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন