করোনাভাইরাস!
নতুন নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার এবং সেই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে কীভাবে উদ্ধার পেতে হয় সে পথও খুঁজে বের করা সময়ের ব্যাপারমাত্র!
২০০২ সালে সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয় পৃথিবীর প্রায় ৮ হাজারের মতন মানুষ, মারা যায় প্রায় হাজারখানেক লোক। এর উৎপত্তি হয়েছিলো বাদুর থেকে। ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে মার্স ভাইরাসের আক্রমনে অসুস্থ হয় প্রায় ২ হাজারের মতন মানুষ, মারা যায় প্রায় ৮০০ এর মতন মানুষ! উৎপত্তি হয়েছিলো উট থেকে। বিড়াল, ইদুর এগুলো থেকেও ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছিল।
বর্তমানে উহান করোনাভাইরাস নিয়ে সবাই রীতিমতো আতঙ্কিত। হওয়াটাই স্বাভাবিক! এ ভাইরাসের উৎপত্তি একপ্রকার সামুদ্রিক ম্যামাল থেকে বলে সন্দেহ করা হলেও, মানুষ থেকে মানুষের শরীরে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। এক প্রকার ছোঁয়াচে বলতে পারেন। প্রাথমিক অবস্থায় সর্দি-কাশি, তারপর নিউমোনিয়া, প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট ও অতঃপর মৃত্যু!
সার্স, মার্স ও উহান করোনা ভাইরাস সবগুলোই সমগোত্রীয় ভাইরাস, একে অপরের মাসতুতো ভাই! গবেষকরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার জন্য, ইতোমধ্যে এর জিনোম রহস্যও আবিষ্কার করা হয়ে গেছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কার করাটা এখন সময়ের দাবি।
প্রশ্ন হলো কতোদিন??? আর ততোদিনে কতগুলো প্রাণ যাবে???
ইতোমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ২০০০ ছাড়িয়েছে চায়নাতে, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫৪! গুটি গুটি পায়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো চায়নাতে, যদিও এই ছড়ানোর হার খুবই কম। আশার আলো হলো ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে ৪৯ জন বাড়ি ফিরেছে।
উহান শহরের আশাপেশের বাকি শহরগুলো সহ টোটাল ৩ কোটি মানুষ এখন একপ্রকার গৃহবন্দী, যোগাযোগব্যবস্থা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন সেখানে। ফ্লাইট, বাস, সাবওয়ে, সকল ধরনের পরিবহন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যাতে করে এখানকার মানুষজন বাহিরে যেতে না পারে। কারণ আক্রান্ত মানুষজন যত বাহিরে যাবে, ততই ছড়িয়ে পড়বে! অসুস্থ পরিবেশ বিরাজ করছে উহানে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় কষ্ট পাচ্ছে খাবারের।
সব সতর্কতাই এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নেয়া। প্রায় ১২০০ জনের মেডিকেল টিম সেখানে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে, তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আর্মড ফোর্স বাহিনী। এই ভলেনটিয়ার টিমের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে উহানের সকল হোটেল। ইতোমধ্যে একজন ডাক্তার অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। চায়না সরকার কোন সতর্কতার কমতিই রাখছেন না। ছয় দিনে ১০০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়েছে। পাবলিককে সতর্ক করার জন্য যা যা করার কোন কমতিই রাখে নি।
বেইজিং এর অবস্থা অতটা খারাপ নয়। তারপরও রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। আজকে ২৬ই জানুয়ারীর রিপোর্ট অনুযায়ী বেইজিং এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫১, তিনদিন আগে ছিলো যেখানে ১৪ জন!
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বেইজিং এর প্রানকেন্দ্রেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খুব কড়াকড়ি ব্যবস্থা জারি করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ডরমেটরিতে বাহিরের সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। যে সমস্ত বিদেশী ছাত্রছাত্রী শীতের বন্ধে নিজ নিজ দেশে বেড়াতে গিয়েছে তাদেরকে পরবর্তী নোটিশ দেওয়া অব্দি চায়নাতে না আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ১২ তারিখ খোলার কথা থাকলেও এখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়া অব্দি যে যেখানেই আছে না কেন, সেখানেই থাকার অনুরোধ করা হয়েছে।
রাস্তাঘাট পুরোই ফাঁকা, সবাই প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকে বের হয় না বললেই চলে।
এবার আসি একটু অন্যকথায়,
আমরা যারা বাহিরে পড়াশুনা করি, দেশ থেকে দূরে থাকার কারনে দেশকে মিস করার পরিমানটা অন্যদের তুলনায় আমাদের ভিতর অনেকটা বেশি কাজ করে! উহানে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশী স্টুডেন্ট গৃহবন্দী অবস্থায় আছে। অনেকে পরিবার নিয়ে থাকেন। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন আয়োজন শুরু করেছে। অনেকে ব্যাক্তিগত ফ্লাইটের আয়োজনও করেছে বা করছে!
আমাদের বাংলাদেশী এম্বাসির ভূমিকাটা কী???
আমাদের এম্বাসি থেকে একটা হট লাইন দিয়েই ক্ষান্ত। সেই নাম্বারে নাকি ২০ বার ফোন দিলে একবার ফোন রিসিভ করেন সম্মানিত দায়িত্বপ্রাপ্তরা, এমনই অভিযোগ উঠেছে!
সত্যি কথা বলতে আপনাদের কিছু করার থাকুক বা না থাকুক, অন্তত ফোনটা রিসিভ করে তো এই অভয়টাতো দিতে পারেন। চিন্তা করবেন না, আমরা আছি আপনাদের সাথে। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে, ধৈর্য ধরুন! খুব এতিম মনে হয়ে এই ধরনের অভিযোগ শুনলে!
চায়নার মতন এমন একটা দেশ হিমশিম খাচ্ছে। এ ভাইরাস যদি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, সতেরো কোটি মানুষ আক্রান্ত হতে বড় জোড় একসপ্তাহই যথেষ্ট! আমাদের বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে চায়না ফেরত যাত্রীদের শুধু শুধু শরীরে জ্বর আছে কিনা তা চেক করেই ছেড়ে দিচ্ছেন আপনারা! কোন ডাটা সংরক্ষনে রাখছেন না এইসমস্ত যাত্রীদের, শুনে তাজ্জব হলাম!
এই ভাইরাস আক্রমনের মিনিমাম পাঁচদিন পর উপসর্গ দেখা দেয়। আপনার থার্মোমিটার স্কিনারে দেখালো যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা নরমাল,আপনারে তাকে ছেড়ে দিলেন! অথচ সে শরীরে ভাইরাস নিয়ে দেশে ফিরলো! এই একজন যাত্রীই যথেষ্ট পুরো বাংলাদেশে ভাইরাস ছড়ানোর জন্য!! আল্লাহ না করুক, একবার ছড়িয়ে পড়লে সামাল দিতে পারবেন??? এটা ডেঙ্গু না! ডেঙ্গুতে কতজনের প্রান নিয়েছেন আপনাদের মনে আছে সংখ্যাটা???
আপনাদেরকে দায়িত্বে কে বসায়? আর কী নিয়ে আপনারা দেশ চালান আল্লাহ ভালো জানেন! ইতিমধ্যে ১২ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস। আরও ছয়টি দেশে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের রোগীদের শরীরের এই ভাইরাস আছে। তাদের অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। আমরা যারা চায়নাতে আছি, আমাদের নিজেদের থেকেও নিজের দেশ নিয়ে বেশি চিন্তা হয়। আল্লাহ আমার দেশকে রক্ষা করো!
চায়নাতে বসবাসরত সবার কাছে একটাই অনুরোধ, মনকে শক্ত করুন এবং সাবধানে থাকুন! ভ্যাকসিনও আবিষ্কার হয়ে যাবে কিছুদিনের ভিতর ইনশাল্লাহ। দয়াল ভরসা! চায়না সরকার সবাইকে ফ্রি ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে। দেশে যারা যাচ্ছেন বা যাবেন তারা ভালো করে চেকয়াপ করিয়ে দেশে যান। আর দেশে যাওয়ার পরও কোন অসুস্থতা অনুভব করলে নিজ দায়িত্বে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যান। নিজে একা ভালো থাকতে গিয়ে ১৭ কোটি মানুষকে ভোগাবেন না!
উহানে আটকে পড়া সকল বাংলাদেশীর জন্য দোয়া কামনা করছি!!
মোঃ আরিফ হোসাইন,
পিএইচডি গবেষক,
বেইজিং টেকনোলজি এন্ড বিজিনেস ইউনিভার্সিটি
বেইজিং, চায়না।
আনন্দবাজার/জায়েদ