শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাণিজ্যিক কূটনীতিতে প্রভাব

বাণিজ্যিক কূটনীতিতে প্রভাব

ঐতিহাসিকভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বঙ্গদেশ ছিল বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম আকর্ষণ। বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি, ভরপুর শস্য উৎপাদন আর সমুদ্র ও নদীপথের অবারিত সুযোগ থাকার কারণে এ অঞ্চল থেকেই সারা বিশ্বে ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের। কালে কালে বাণিজ্যের এই গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে জোরদার হয়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক। এ অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণভিত্তিক সম্পর্ক উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো। ঐতিহ্যের সেই পথ ধরে একবিংশ শতকে এসে ভূরাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ ঘিরে আগ্রহ বেড়েছে বিশ্বশক্তিগুলোর। এতে বাংলাদেশের সামনে অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে সফল্যের বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

একাত্তরে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতি বা ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি তেমনভাবে আলোচনায় ছিল না। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রফতানি বা ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কূটনীতির ধারণা। সত্তরের দশকের পর থেকে সেই ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয়। যা ঘিরে বৈশ্বিক রাজনীতি বা পররাষ্ট্রনীতির পুরো কাঠামোই পাল্টে যেতে থাকে। বর্তমানে নতুন নতুন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষায় বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোসহ গৃহীত নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা সমন্বয়ে কূটনীতির গুরুত্ব যেমন বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও বাড়াতে হচ্ছে যোগাযোগ।

মূলত, বৈশ্বিক বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করার জন্যই যেকোনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের জন্য এখন অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি করে দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রভাব দিন দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি গুরুত্ব পাচ্ছে অনেক বেশি। যার পেছনে কাজ করছে মূলত বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-রাজনীতি। বিশেষ করে এশিয়ায় অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রভাবে সামনের সারিতে রয়েছে লাল-সবুজ পতাকার দেশটি। প্রতিবেশীর সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য নতুন করে ২৩টি দেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  অনলাইন ভ্যাট রিটার্ন শীর্ষে কুমিল্লা অঞ্চল

বিশ্ববাণিজ্যে স্নায়ুযুদ্ধের এই সময়ে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নতুন করে রূপ নিয়েছে অর্থনৈতিক পররাষ্ট্রনীতি বা বাণিজ্যক কূটনীতিতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। দেশীয় পণ্যের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে দেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোকে আগেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাণিজ্য কূটনীতিকে বাংলাদেশ যে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে তা বার বার তা উঠে এসেছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রীও বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, ভিয়েতনাম, চীনসহ বিভিন্ন দেশের দিকে না গিয়ে বিশ্বাবাসী এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে। এর পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক কারণ তথা অর্থনৈতিক কূটনীতির সাফল্য।

বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রভাব যে বাড়ছে তা উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক লোয়ি ইনস্টিটিউটের এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স-২০২১ র‌্যাংকিংয়ে। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম। যদিও গেল বছরে ২৬টি দেশের মধ্যে দেশের অবস্থান ছিল ১৮তম। তবে কূটনৈতিক প্রভাব ও প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের সূচকে এসেছে বড় উন্নতি। অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ পুঁজির দিক থেকে আগের মতো শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে অর্থনৈতিক সক্ষমতার সূচকে অবস্থান আগের মতো ১৬তম আর ভবিষ্যৎ পুঁজির সূচকে একধাপ এগিয়ে ১৬তম।

লোয়ি ইনস্টিটিউটের হিসাবে, কোনো দেশের সঙ্গে যেসব দেশ বা অঞ্চলের বাণিজ্য বেশি, তারাই ওই দেশটির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হওয়ায় এ দেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। দ্বিতীয় অবস্থানে চীন, তৃতীয় ভারত, চতুর্থ যুক্তরাষ্ট্র এবং পঞ্চম যুক্তরাজ্য। একইভাবে যেসব দেশের ওপর বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটায়, সেসবের মধ্যে শীর্ষে ভারত, দ্বিতীয় পাকিস্তান, তৃতীয় রাশিয়া, চতুর্থ ইন্দোনেশিয়া, পঞ্চম শ্রীলঙ্কা। লোয়ি তালিকায় একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র আর চীনই পরাশক্তি ক্যাটাগারিতে ঠাঁই পেয়েছে। মধ্যম শক্তি হিসেবে তৃতীয় শক্তি জাপান, চতুর্থ ভারত। শীর্ষ দশের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া। যাদের মধ্যে বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক বেশি শক্তিশালী।

আরও পড়ুনঃ  আকাশছোঁয়া দরে অস্থিরতা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখন অবধি বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য বিশাল এক অর্জন। যার মূল কারিগর হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত সেই নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ তৈরি করে দিয়েছে। আজ দেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে বড় প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে মূলত এই নীতির কারণেই। বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশকে তিনি প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসাবে তৈরি করবেন। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক ভিশন বা দূরদৃষ্টির পরিপূর্ণ রূপ আজকের বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রভাব বিস্তার।

রাষ্ট্রবিদদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের গোটা বিষয়ই ছিল প্রকৃতপক্ষে বড় ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য। তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ফিরে আসার পরে তিনি যেভাবে কমনওয়েলথ এবং নন এলাইন মুভমেন্ট, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসি এবং জাতিসংঘে তিনি ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা নজিরবিহীন।

বাংলাদেশে মূলত বিশ্বব্যাংকই বহুপাক্ষিক দাতাগোষ্ঠী হিসেবে সব শক্তির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এরপরই সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে জাপান। পরাশক্তি চীন, রাশিয়া, ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্কে আবদ্ধ বাংলাদেশ। তবে দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে দাতা বা সহায়তাকারী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বড় ধরনের কোনো বিচ্যুতি বা ফাটল কখনই দেখা দেয়নি। বাংলাদেশ সব সময়ই আত্মমর্যাদার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রেখেছে। কূটনৈতিক সেই সুসম্পর্ক শেষ অবধি ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোকে সম্প্রসারিত করেছে।

আরও পড়ুনঃ  একদিনে আক্রান্ত ৩৫০৪, মৃত্যু ৩৪

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে। মাথা পিছু আয়সহ প্রায় সব সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিল্প ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতির ধারা শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক কূটনীতির পথ ধরেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ বেড়েছে। সরকারি তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ৬৮ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সমকক্ষ দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণে এমন সাফল্য পেয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যে অনেক নিচে সেটা একটা বাস্তবতা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন