মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রবৃদ্ধিতে কালো মেঘ

প্রবৃদ্ধিতে কালো মেঘ

চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৫.২ শতাংশে নামবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যা আগের বছরের ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থেকে কম। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে বলা হয়েছিল, ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বাংলাদেশের। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস জানুয়ারি ২০২৩’ নামক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য সামনে এনেছে বিশ্বব্যাংক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, গৃহস্থালীর আয় ও সংস্থাগুলোর ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব, সেইসাথে জ্বালানি ঘাটতি, আমদানি বিধিনিষেধ এবং মুদ্রানীতি কঠোর হওয়ার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫.২ শতাংশে নামবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অনুমিত এই প্রবৃদ্ধি আগের বছরের ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় কম। কিন্তু আশা করা হচ্ছে, এটি আবারও বাড়বে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ তার সম্ভাব্য গতিতে ফিরে আসবে। অবশ্য পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম এবং পরিবার ও ব্যবসার জ্বালানি চাহিদা মেটানোর বিষয়ে বাংলাদেশ বেশ সংকটের মধ্যে ছিল। মূলত, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর মধ্যেই চলতি ২০২৩ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রায় অর্ধেক কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর বিশ্ব অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসও কমিয়ে সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নামবে ৫.২ শতাংশে।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ঋণদাতা এই সংস্থার মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকটে পড়ার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির জেরে সরকার জ্বালানি খরচ কমাতে ব্ল্যাকআউট এবং কারখানা বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। একইসঙ্গে যানবাহন ক্রয় বন্ধ করে দেওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে বিলাসবহুল পণ্য ক্রয় করাও কঠিন করে বাংলাদেশ সরকার।

আরও পড়ুনঃ  দাম কমলো এলপিজি সিলিন্ডারের

বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনা মহামারির কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি ‘বিপজ্জনকভাবে মন্দার কাছাকাছি’ আসবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বিশ্বব্যাংক। গত মঙ্গলবার ফের সতর্ক করে বলেছে, বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি – যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনের – দুর্বল প্রবৃদ্ধির জেরে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

এদিনই ২০২৩ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রায় অর্ধেক কমিয়েছে তারা। মূলত সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানোর প্রবণতা, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন অব্যাহত ও বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর নড়বড়ে অবস্থানের কারণে দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছে। আর এর জেরেই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

বৈশ্বিক এই ব্যাংক জানিয়েছে, তারা ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে প্রত্যাশা করছে। ২০০৯ সাল ও ২০২০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়টা বাদ দিলে গত তিন দশকের মধ্যে এটিই হবে সবচেয়ে ধীর প্রবৃদ্ধির হার। তারা বলছে, প্রবৃদ্ধির হার কমায় উদীয়মান অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এসব দেশ ঋণের বোঝা মোকাবিলা করতে সমস্যায় পড়বে।

এছাড়া দুর্বল মুদ্রা, আয়ের প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা ও বাণিজ্যখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে থাকায় পরবর্তী ২ বছরে এই দেশগুলোতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হয়েছে, যা গত ২ দশকের তুলনায় অর্ধেক। ২০২২ সালের শেষের দিকে এসে জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের কারণে কিছু পরিমাণে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে এসেছে, তবে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, সরবরাহ খাতে নতুন করে বিঘ্ন দেখা দেওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি এবং সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ধারা অটুট থাকতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  রোবট আসায় শঙ্কা বাড়ছে পোশাক শ্রমিকদের

বিশ্বব্যাংক আরও জানিয়েছে, এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো প্রতিক্রিয়া হিসেবে পলিসি রেট বর্তমান প্রত্যাশিত হারের চেয়ে বেশি হারে বাড়াতে পারে। এসব উদ্যোগের পরিণাম হিসেবে বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাব তীব্র হচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে এবং বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির চালিকা শক্তি থমকে গেছে। এসব কারণে ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি কমে আসবে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। যা ২০০৯ ও ২০২০ সালের মন্দার বাইরে ১৯৯৩ সালের পর সবচেয়ে কম। যেখানে গত জুনেও ৩ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
ঋণদাতা সংগঠনটি ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। তবে ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গড় প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের নিচে হবে। ১৯৬০ সালের পর পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম।

বিশ্ব ব্যাংক আরও বলছে, ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুদের হারের আকস্মিক বৃদ্ধি, কোভিড-১৯ মহামারি থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কিংবা ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতিকে ধাক্কা দিতে পারে।
উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য পরিস্থিতি কঠিন হবে। কেননা তারা ভারী ঋণের বোঝা, দুর্বল মুদ্রা ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করছে।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বিবৃতিতে আরও বলেছেন, প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগে দুর্বল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য এবং অবকাঠামো ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে বিধ্বংসী পরিবর্তন আরও জটিলতা তৈরি করবে। ২০২২ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭-এ নেমে আসে, যা ২০২০ এর পরে ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে দ্বিতীয় ধীর গতি সম্পন্ন। জিরো-কোভিড বিধিনিষেধ বাজারে অস্থিরতা, উৎপাদন ও বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দেশটির। চীনের প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে ৪ দশমিক ৩-এ ফিরে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু কোভিড সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া এবং বাহ্যিক চাহিদা দুর্বল হওয়ার কারণে গত জুনের পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ পয়েন্ট কম।

আরও পড়ুনঃ  আঙুলের খোঁচায় উঠছে প্রলেস্তর, কাজে নিম্নমানের সামগ্রীর ব্যবহার

বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করেছে, মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমতে শুরু করেছে কোথাও কোথাও। কিন্তু সতর্ক করেছে নতুন করে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি বেশি এবং মুদ্রাস্ফীতি অব্যাহত থাকতে পারে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বর্তমান প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সুদের হার বাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী মন্দা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে খাদ্য ও জ্বালানির ধাক্কা সামলাতে, সংঘর্ষের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া লোকজন ও ঋণ সংকটের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বর্ধিত সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, জলবায়ু অভিযোজন, মানবিক পুঁজি ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেসরকারি পুঁজি ও দেশীয় সম্পদের পাশাপাশি নতুন ছাড়যুক্ত অর্থায়ন ও অনুদান প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে প্রসারিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব ব্যাংকের বোর্ড এ সপ্তাহে একটি নতুন ‘রোড ম্যাপ’ বিবেচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে বৈশ্বিক মন্দা নিয়ে সতর্ক করেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা। তিনি বলেন, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ মন্দার মধ্যে থাকবে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন