শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শর্তে বাঁধা ঋণ

শর্তে বাঁধা ঋণ

নানা শর্তে বাঁধা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ। তবে সবগুলো শর্তই পুরনো। নতুন কোনো শর্ত জুড়ে দেয়নি তারা। বিভিন্ন সময়ে দেয়া পরামর্শগুলো এখন শর্ত হিসেবে দেয়া হচ্ছে। সবগুলো শর্তই দেয়া হচ্ছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য। এ শর্তগুলো পূরণ করলেই মিলবে প্রথম কিস্তির দেড় বিলিয়ন ডলার।

বিশ্ব আর্থিক খাতের অন্যতম প্রধান মোড়ল এ সংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণের হার হ্রাস, রাজস্ব আদায় বাড়াতে রাজস্ব খাতের ব্যাপক সংস্কারের কথা বলে আসছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান, বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানের করা, বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়সহ নানা পরামর্শ দিয়ে আসছে সংস্থাটি। তবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এসব পরামর্শ এতদিন আমলে নেয়নি। বাংলাদেশের প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে আইএমএফ এই ঋণ দিতে প্রাথমিকভাবে রাজিও হয়েছে। তবে সুযোগ বুঝে পুরোনো পরামর্শগুলোকেই এখন ‘শর্ত’ হিসেবে হাজির করে সরকারকে বাস্তবায়ন করতে বলছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের সমস্যা, সংস্কার, কার্যক্রম, পরিচালনা পর্ষদের গঠন, খেলাপ ঋণ আদায়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি, বিভিন্ন তদবির, ব্যাংক খাতের সংস্কার, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা, খাতভিত্তিক আর্থিক ইন্ডিকেটরস, বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ১০টি দুর্বল ব্যাংকের জন্য নেওয়া উদ্যোগ, ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্ট (এফএসএসপি) বাস্তবায়ন, ব্যাংক সুপারভিশন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন (সংশোধন) আইনসহ ৫টি অন্যতম আইনের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন।

এক বছর আগেও দেশে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের (৪৮ বিলিয়ন) বেশি। আমদানি খরচ বাড়ায় যা এখন কমে হয়েছে ৩ হাজার ৫৮৫ কোটি (৩৫.৮৫ বিলিয়ন) ডলার। রিজার্ভ থেকে ৭ বিলিয়ন দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানিকারকদের জন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুনঃ  আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে বন্যা

আইএমএফ বলছে, এসব বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব করতে হবে। কারণ রিজার্ভের এসব অর্থ চাইলেই ফেরত পাওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। আইএমএফের শর্ত মানলে বর্তমানে রিজার্ভ কমে হয় ২৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা নেমে আসবে ২৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। সেপ্টেম্বরে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। সেই হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব নিয়ে। আইএমএফ বলছে, ভুল শ্রেণিকরণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের আকার বড় হয়েছে বলে দাবি করে আইএমএফ। ২০২১ সালে আইএমএফ বলেছিল, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থাকার যে কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। রিজার্ভবহির্ভুত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করে রিজার্ভ ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আইএমএফের প্রতিনিধিরা অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জানিয়ে দিচ্ছেন কোথায় কী ধরনের সংস্কার করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কিছু না বললেও যাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের অনেকেই বলেছেন, আর্থিক ও রাজস্ব খাতের কয়েকটি বিষয়ে সংস্কার করতে বলেছে সংস্থাটি। এ বিষয়গুলো আগেও তারা বলেছেন। এখন নতুনভাবে বলছেন। এটাকে এক ধরনের শর্তই বলা যায়। এসব সংস্কার করলে তারা দ্রুত ঋণটা ছাড় করবেন।

আইএমএফের এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় এসেছে। প্রতিনিধিদল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবে। এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে সোমবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

ঢাকায় এসেই তারা অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেন। পরের দিন বৈঠক হয় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে রোববার আবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। বৈঠকে ব্যাংকিং খাতের বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।

আরও পড়ুনঃ  ফাইলচাপায় বন্দর উন্নয়ন

ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না সে বিষয়েও জানতে চেয়েছেন তারা। খেলাপি ঋণ ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন, মুদ্রানীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি, ঋণের সুদ ও মুদ্রার বিনিময় হার, সঞ্চয়পত্রের সুদহার, বন্ড ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়। আইএমএফের বিভিন্ন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে বলে জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সোয়া লাখ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ৯ শতাংশ। আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরে এই হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে আসছে। ঋণের শর্ত হিসেবে নতুন করে এ বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছে আইএমএফ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টিও বেশ জোরেশোরে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে কোনো বৈঠক শেষেই আইএমএফের কোনো প্রতিনিধি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। সংস্থাটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বৈঠকের বিষয়ে কোনো বিবৃতিও দেয়া হয়নি।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব নিয়ে। আইএমএফ বলছে, ভুল শ্রেণীকরণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের আকার বড় হয়েছে বলে দাবি করে আইএমএফ। ২০২১ সালে আইএমএফ বলেছিল, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থাকার যে কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। রিজার্ভবহির্ভূত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করে রিজার্ভ ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আইএমএফ বলছে, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব করতে হবে। কারণ রিজার্ভের এসব অর্থ চাইলেই ফেরত পাওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। আইএমএফের শর্ত মানলে বর্তমানে রিজার্ভ কমে হয় ২৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা নেমে আসবে ২৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। সেপ্টেম্বরে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। সেই হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ  প্রায় ৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তেলর দাম

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ রিজার্ভ থাকতে হয়। সে বিবেচনায় বেশ অস্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ। তবে আশার কথা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মধ্যে আইএমএফের ঋণের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির দেড় বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে। এ ঋণটা পাওয়া গেলে সংকট কিছুটা হলেও কেটে যাবে।

নয়-ছয় সুদহার সীমা প্রত্যাহার চায় আইএমএফ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধি দল মুদ্রানীতির কাঠামো পরিবর্তন করতে বলেছে। রিজার্ভ মানির ওপর সীমা আরোপ ও সুদহারের সীমা তুলে দিতেও বলেছে তারা। পাশাপাশি বন্ডের বাজার উন্নয়ন ও সঞ্চয়পত্রের সংস্কার আনতে বলেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহারের সীমা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়াতে পারছে না, আমানতে বেশি সুদ দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের সুদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা পড়েছেন চরম বিপাকে। এতে কমছে ব্যাংকের আমানতও। আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংককে বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছে। পরে বছরে চারবার ঘোষণা করতে বলেছে।

ভাসমান বিনিময় হার

প্রতিনিধি দলটি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হারের ওপর জোর দেয়। তারা প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ প্রণোদনা তুলে দিয়ে ডলারের দাম আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেয়। এতে প্রবাসী আয় বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। পাশাপাশি বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা স্থায়ী করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তারা।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ কোনো ব্যতিক্রম দেশ নয়। সারা পৃথিবীতে সংকট চলছে। এর মধ্যে কিছু দেশ কম খারাপ। আর কিছু দেশ বেশি খারাপ অবস্থায় আছে। কেউ স্বস্তিতে নেই। কাউকে দোষারোপ করব না। এখন আমাদের নিজের ঘর গোছাতে হবে। এই কাজের একটি হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব আইএমএফের ঋণটা আমাদের পেতেই হবে। এ জন্য যদি সংস্থাটির কিছু শর্ত মানতে হয়, সেটি মেনেই ঋণটা নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন