শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্রয়ক্ষমতার ঘাড়ে মূল্যস্ফীতি

ক্রয়ক্ষমতার ঘাড়ে মূল্যস্ফীতি

মূল্যস্ফীতি গোপন বিষ, যা সামাজিক অস্থিরতা আর রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে পারে: ব্রুনো লে মায়ার, অর্থমন্ত্রী, ফ্রান্স

২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে কর্মীদের জন্য খারাপ সময় আসতে যাচ্ছে: ড. লি কোয়ান, আঞ্চলিক পরিচালক, ইসিএ ইন্টারন্যাশনাল, এশিয়া

মন্দার ঝুঁকি মোকাবিলায় মুদ্রাস্ফীতি প্রশমনের কৌশল ব্যবহার করতে হবে: রেবেকা গ্রিনস্প্যান, মহাসচিব, আঙ্কটাড

বৈশ্বিক সংকটের অন্ধকার ঘন হচ্ছে। একের পর এক সংকট নাজুক অবস্থায় ফেলছে অর্থনীতিকে। অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশ। গত দুই বছরে করোনা মহামারির ধাক্কা, রাজনৈতিক সংঘাত আর সঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে উদ্ভুত সংকটে দিশেহারা গোটা বিশ্ব। এর মধ্যে ধেয়ে আসা মহামন্দা নিয়ে নানা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে উন্নত দেশেও। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি।

প্রবল মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে হুহু করে। যার প্রভাব পড়ছে দৈনন্দিন জীবনে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রয়েছে নাজুক পরিস্থিতিতে। এসব অঞ্চলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে। যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। উন্নয়নশীল আর উন্নয়নকামী এসব দেশে সর্বোচ্চ মাত্রার মূল্যস্ফীতি জনজীবনকে দুর্বিষহ অস্থির করে তুলছে।

অন্যদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম একেবারেই ঊর্ধ্বমুখী। আর সেই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কমেছে ডলারের দাম। বিপরীতমুখী এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি চরম আকার নিচ্ছে। এশিয়ান বাণিজ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য আরও বেড়েছে। এর আগের সেশনেও মূল্য বেড়েছে তিন শতাংশ। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ইউএস ক্রুডের চাহিদা বাড়ায় ও ডলারের দুর্বল প্রবণতার কারণেই মূলত তেলের দাম বেড়েছে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা তথ্যমতে, ২০২২ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্যমূল্যের মুদ্রাস্ফীতি গড়ে ২০ শতাংশের বেশি। একই সময়ে লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়াসহ অন্যান্য অঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক কম। গড়ে ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে।

আরও পড়ুনঃ  বক্তব্য ‘টুইস্ট’ করা হয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মূল্যস্ফীতির কারণে বিশেষ করে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। গত বছরের গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্সের তথ্যমতে, খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। এছাড়া, জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে বিশ্বের ৫৪ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে।

তবে মূল্যস্ফীতির বিপদে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোই নয়, বড় শঙ্কায় রয়েছে ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোও। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির প্রতিবাদে ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। অন্যদিকে, তিন দশকেরও বেশি সময়ের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়।

অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যান ব্যুরো এবিএসের ডেটা অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া প্রান্তিকে দেশটিতে ভোক্তা মূল্যসূচক বেড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। যেটি ১ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে আভাস পাওয়া গিয়েছিল। গৃহনির্মাণ ও গ্যাসের দর বৃদ্ধিতে অস্ট্রেলিয়ায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৩২ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

শুধু তাই নয়, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রোমানিয়ায় রাস্তায় নামে শত শত মানুষ। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তারা। এছাড়া ফ্রান্সেও শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। বেতন বাড়ানোর দাবিতে সেখানের নাগরিকরা পালন করেছেন নানা কর্মসূচি। কারণ বর্তমান মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী তাদের বেতন বাড়েনি।

এদিকে, চেক রিপাবলিকে সরকারের জ্বালানি সংকট মোকাবিলার ইস্যুতে বিক্ষোভ দেখা গেছে। অসহনীয়ভাবে মূল্য বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যের রেল শ্রমিকরা ও জার্মানির পাইলটরা ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করেছেন।

মূলত, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইউরোপে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় অঞ্চলটির ১৯ দেশে মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশে। এতে মানুষের পণ্য কেনার ক্ষমতা কমে গেছে। কিনতে পারছেন না প্রয়োজনীয় জিনিস। আর তাতেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন তারা।

আরও পড়ুনঃ  হলুদ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষকরা

অন্যদিকে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই আসলে দেশে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। যা বেতন বাড়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে। কর্মশক্তি পরামর্শদাতা ইসিএ ইন্টারন্যাশনাল ৬৪টি দেশ ও শহরের ৩৬০টিরও বেশি বহুজাতিক কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে, বেতন ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ইউরোপ। যেখানে মূল বেতন কমছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ।

চলতি বছর খারাপ সময় পার করছে যুক্তরাজ্যের কর্মীরা। ২০০০ সালে জরিপ শুরু হওয়ার পর এটাই তাদের সবচেয়ে বেশি খারাপ সময়। দেশটিতে ৯ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কারণে নোমিনাল বেতন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়লেও রিয়াল-টার্ম বেতন কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। মনে করা হচ্ছে ২০২৩ সালে এখানে বেতন আরও ৪ শতাংশ কমতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে রিয়াল-টার্ম বেতন কমেছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসলে বেতন ১ শতাংশ বাড়তে পারে।

ইসিএ ইন্টারন্যাশনালের এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড. লি কোয়ান বলেন, জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে কর্মীদের জন্য একটি খারাপ সময় আসতে যাচ্ছে। কারণ মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দেশে বেতন বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যদিও ২০২২ সালে গড় বেতন কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

সম্প্রতি বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, বিশ্ব ‘মন্দার দ্বারপ্রান্তে’ এবং এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো মন্দার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। পূর্বাভাসে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট এবং ২০২০ সালে করোনা মহামারি সংকটের চেয়েও বড় বড় সংকট ঘনীভূত হতে পারে। এতে সব অঞ্চল প্রভাবিত হবে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদের ঘণ্টা বাজছে। যার মধ্যে অনেকগুলো ঋণ খেলাপির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  চালের দাম বস্তা প্রতি বেড়েছে ২০০ টাকা

আঙ্কটাড-এর মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের সতর্ক করা দরকার যে আমরা একটি নীতি-প্ররোচিত বৈশ্বিক মন্দার দ্বারপ্রান্তে। আমি আবারও বলছি, আরও বাস্তবসম্মত নীতির মিশ্রণ, পণ্যমূল্যের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটাতে আমাদের আরও বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে। গ্রিনস্প্যান আরও বলেছেন, মন্দার ঝুঁকি থেকে সরে আসার সময় আছে, যদি দেশগুলো তাদের কাছে থাকা কৌশলগুলোকে মুদ্রাস্ফীতি প্রশমিত করতে ও ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তার জন্য ব্যবহার করে।

ফ্রান্সের অর্থনীতি, অর্থ ও শিল্প ও ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব বিষয়ক মন্ত্রী ব্রুনো লে মায়ার বলছেন, ২০২১ সালের শেষের দিক থেকে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির সংকটে ভুগছে ইউরোপীয় দেশগুলো। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। ইউরোপের নাগরিক, অর্থনীতিবিদ ও অর্থমন্ত্রীরা বহুদিন এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। এটি আমাদের জন্য নতুন ও খুবই উদ্বেগের বিষয়।

ব্রুনো লে মায়ার আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি একটি গোপন বিষ। এটি অর্থনৈতিক মন্দা বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি রাজনৈতিক সংকটেরও জন্ম দিতে পারে। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয়। ইউরো জোনে যত দ্রুত সম্ভব দুই শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো উচিত। তার জন্য আর্থিক ও জ্বালানি উভয় সমস্যা মোকাবিলায় সমন্বিত কৌশল গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন