শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতা--

ভরাবর্ষাতেও ‘মরুময়’ চলনবিল

ভরাবর্ষাতেও ‘মরুময়’ চলনবিল

অর্ধাহার-অনাহারে জেলে-নিম্ন আয়ের মানুষ

অর্ধাহার-অনাহারে জেলে-নিম্ন আয়ের মানুষ

বর্ষা মৌসুমে দেশের বৃহত্তম চলনবিলের মাঠ-ঘাট রাস্তা তলিয়ে যায় পানিতে। ছোট বড় সব নালা, খাল-বিল থৈ থৈ করে পানির কলতানে। পানিতে ভরপুর থাকে গোটা চলনবিল। বাহারী সব নৌকা পাল তুলে কখনো বা ইঞ্জিন চালিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় চলনবিল এলাকার নানা প্রান্তে। তবে এবার চলনবিলে ভরা বর্ষাতেও পানি নেই। যার প্রভাব পড়েছে তিন জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই বিলের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এক দশক আগেও আষাঢ় শ্রাবণ মাসে চলনবিল থাকতো পানিতে টইটম্বুর। এখন গোটা বিল পানিশূন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতায় শিকার হতে চলছে এই বিল। এক সময় ধান ও মাছে পরিপুর্ণ ছিল চলনবিল। বিল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শত শত দ্বীপের মতো গ্রামগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করতো। অধিকাংশ গ্রামবাসী মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতো।

বর্ষাকালে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো ভ্রমণ পিপাসু মানুষগুলো চলনবিলকে কাছ থেকে একনজর দেখার জন্য ছুটে আসতো। নৌভ্রমণের মাধ্যমে চলনবিলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেন তারা। মূলত নির্মল প্রাকৃতিক আবহাওয়া, পানিতে দোল খাওয়া, নানা প্রকার দেশি বিদেশি পাখির কলতান, দেশি মাছের স্বাদ, বিনোদন আর শহরের এক ঘেঁয়েমিপনা দূর করতেই পর্যটকরা আসতেন দেশের নানাপ্রান্ত থেকে। সেই সঙ্গে স্থানীয় লোকদেরও দু’পয়সা আয় রোজগার হতো। বর্তমানে চলনবিল পানিশূন্য থাকায় বিলুপ্ত হতে বসেছে বিলের জীববৈচিত্র ও মৎস্যসম্পদ। ব্যাহত হচ্ছে কৃষি আবাদও।

রাজশাহী বিভাগের ৬ জেলার এক হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিল চলনবিল। বর্তমানে নাটোর. পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এই তিন জেলার ১০টি উপজেলার, ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। বিলে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ও ৯৩টি ছোট বিল।

আরও পড়ুনঃ  নীলফামারীর ৪টি আসনের ২টিতে নৌকা ও ২টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয়

পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, চলনবিলে মাছের উৎপাদন ছিলো ১৯৯২ সালে ১৮ হাজার ৭০০ টন, ১৯৯৭ সালে ১৫ হাজার ৪২১ টন, ২০০২ সালে ১২ হাজার ৪৬০ টন এবং ২০০৬ সালে উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ১১৭ টন। এই হিসাবে ২৪ বছরে চলনবিলে মাছের উৎপাদন কমেছে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ। গড় উৎপাদন কমেছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবছর উৎপাদন কমেছে ৩ শতাংশ।

চলনবিলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জলবায়ুর পরিবর্তন, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ছোট-বড় ব্রিজ, কালর্ভাট, ডুবন্ত সড়ক, অপরিকল্পিত বাদ নির্মাণ, নতুন বসতি স্থাপন এসবের কারণে ভরাবর্ষা মৌসুমেও চলনবিলে যে পরিমাণ পানি থাকার কথা, তা আর নেই।

এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে চলনবিলে বর্ষা মৌসুমে পানিতে ভরপুর থাকতো। উঁচু জমিতে ফসল আবাদ, নদী-খালে মাছ শিকার চলতো। অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, প্রকৃতির বৈরি আচরণের কারণেই বৃহৎ এই বিল এখন পানিশূন্য। চলতি বর্ষা মৌসুমে পানিশূন্যতায় ধুঁকছে চলনবিলের জলাশয়গুলো। নেই তেমন বৃষ্টিপাতও। তাই দেখা মিলছে না মাছেরও। এ কারণে অলস সময় পার করছেন এ অঞ্চলের জেলেরা। অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে তাদের জীবন।

চলনবিলাঞ্চল এলাকার শুকুর রমিজ ও সাবুদের শুকনো মৌসুমে অন্যের জমিতে কাজ করে আর বর্ষায় মাছ ধরে আর নৌকায় ভাড়া মেরে সংসার চলতো। কিন্তু এবার বর্ষায় বিলে পানি না আসায় তারা হতাশ। কারণ মাছ বিক্রি করেই ছেলে- মেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের যাবতীয় খরচ যোগাতে হয় তাদের। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্য দিকে কাজ না থাকায় প্রচণ্ড কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা।

আরও পড়ুনঃ  ব্যাংক বিশেষ প্রয়োজনে খোলা থাকবে

নাটোরের গুরুদাসপুরের বিলশা গ্রামের মৎস্যজীবিরা বলেন, মাছ ধরেই চলে আমাদের জীবন জীবিকা। তাই বর্ষা শুরুর আগেই মাছ ধরার জন্য খেয়া জাল, জাকই জাল, ধুন্দি, চাঁই, দোয়ার, পলোসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করে রেখেছি। অথচ ভরা বর্ষায় পানি না থাকায় আমাদের উপার্জনের পথ বন্ধ হতে বসেছে।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান জানান, ফারাকার বাঁধ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, অবৈধ দখল দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চলনবিল এখন বর্ষা মৌসুমেও পানিশূন্য।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন