শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বন্যার ভয়াবহতা --বিশ্লেষণ

নদ-নদীর সঙ্গে জলবায়ুর থাবা

নদ-নদীর সঙ্গে জলবায়ুর থাবা

উন্নয়ন আগ্রাসনে দখল-দূষণ-জলাশয়ভরাট

ভয়াবহতার কারণ—

  • আসাম মেঘালয়ে অতিবর্ষণ
  • নদীর পানিবহন ক্ষমতা নষ্ট
  • অপরিকল্পিত নির্বিচার উন্নয়ন
  • শহররক্ষা বাঁধ তৈরি না করা
  • ইটনা-মিঠামইন সড়কের দায়

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে হঠাৎ করে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। উজানে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ভেসে গেছে গ্রাম আর শহর। মহাবিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এ নিয়ে চলতি মৌসুমেই তৃতীয় দফার বন্যার কবলে পড়েছে গোটা সিলেট বিভাগ। সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা বলছেন, বহু বছরের মধ্যে তারা এতো মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হননি। কর্তৃপক্ষের বরাতে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৩৫ লাখের বেশি মানুষ।

কেন বার বার বন্যায় ভাসছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের জেলাগুলো? কেন বার বার তলিয়ে যাচ্ছে সুনামগঞ্জ? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা রেকর্ডভাঙা ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে নদ-নদীর পানি ধারনক্ষমতা হ্রাসের কথা বলছেন। কেউ বলছেন অপরিকল্পিত নির্বিচার উন্নয়নের কথা। কেউ আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই যে বন্যার ভয়াবহতা বাড়ছে সেই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তবে বর্তমানের প্রতিটি দুর্যোগের পেছনেই উন্নয়ন আগ্রাসনের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় উঠে আসছে।

তথ্যমতে, বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার পানি সরাসরি এসেই বাংলাদেশের হাওরে মেশে। ভৈরব বা মেঘনা নদী হয়ে তা চলে যায় সাগরে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতের বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপট আর এখনকার নদীগুলোর অবস্থার মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। নদী গবেষকদের মতে, এইরকম আকস্মিক বন্যার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ।

আরও পড়ুনঃ  বিশ মাস পর ঢাবিতে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সংবাদমাধ্যমে জানাচ্ছেন, চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টির কারণে এবার দেশে বন্যার ভয়াবহতা রেকর্ড ভেঙেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া-জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। এখন বৃষ্টি হলে অনেক বেশি গভীর বৃষ্টি হয়। প্যাসিফিকেও একটা লা নিনো আছে। সেটাও অতিবৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তবে হঠাৎ বন্যার প্রধান কারণ চেরাপুঞ্জির প্রবল বৃষ্টিপাত।

গবেষকরা বলছেন, দখল ও দুষণে নদীর নাব্যতা কমে গেছে। এতে নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। আগে বৃষ্টির প্রচুর পানি বহনের ক্ষমতা ছিলো নদীগুলোর। এখন সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আগে আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতো। কিন্তু এবার হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে পারেনি। যে কারণে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে।

নদী গবেষক মুমিনুল হক সরকার বলন, প্রতিবছর উজান থেকে পানির সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে।

নদীর নাব্যতা নষ্টের জন্য ভারত অংশে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনকে দায়ী করে অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে। সেখানে গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং হচ্ছে না। যে কারণে পানি বহন করতে পারছে না নদীগুলো। এই কারণে মেঘালয় বা আসামে বেশি বৃষ্টিপাত হলেই সিলেট বা কুড়িগ্রাম এলাকায় বন্যার তৈরি হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  বঙ্গবন্ধু রেলসেতু প্রকল্পের ব্যয় বাড়ল ৭ হাজার কোটি টাকা

অপরিকল্পিত উন্নয়নকে বন্যার আরেকটি কারণ উল্লেখ করে গবেষকরা বলছেন, একের পর এক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, করা হচ্ছে রাস্তাঘাট। এসব স্থাপনা তৈরি করতে ভরাট করা হচ্ছে বিভিন্ন জলাশয়। যেগুলো আগে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতো। কিন্তু এখন তা আর পারছে না। আগে সহজে বাড়তি পানি নদীতে মিশে যেতে পারলেও এখন সময় লাগছে অনেক। নদী গবেষক মমিনুল হক সরকার বলেন, হাওরে যেসব রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই হাওরের পানি চলাচলে মূল বাধার তৈরি করছে। এরকম অনেক রাস্তা কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়া তৈরি করা হয়েছে।

মে মাসের শেষ দিকে একবার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল সিলেট। এ নিয়ে এই অঞ্চলে এই বছর তিনদফা বন্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই সুনামগঞ্জের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নেত্রকোনার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রেল যোগাযোগ। এর পাশাপাশি রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ দেশের আরও অন্তত ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তার খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। বুয়েটের বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, হাওরে এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়নি। আশ্রয়কেন্দ্রও তৈরি করা হয়নি। ফলে যখন এভাবে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, সেটার ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  ফেসবুকে ব্যবসায় তরুণদের বিপ্লব

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন