ঢাকা | মঙ্গলবার
৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফেসবুকে ব্যবসায় তরুণদের বিপ্লব

ফেসবুকে ব্যবসায় তরুণদের বিপ্লব
  • ঘরে ঘরে গড়ে উঠছে শিল্প
  • দেশে হাজার কোটি টাকার বাজার

বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির মহাবিপ্লব দশক দুই আগেই বাতিল করে দিয়েছে প্রথাগত অর্থনীতির বাজার। ক্রেতা, বিক্রেতা আর পণ্য বেচাকেনার স্থান সম্পর্কিত ধারণাও আমূল পাল্টে দিয়েছে গেল এক দশকে। আর বাণিজ্যের এই বিস্ময়কর বিপ্লব এনেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষ করে মার্ক জাকারবার্গের আবিষ্কার করা বিস্ময়কর প্রদীপ ফেসবুক। যা বাণিজ্যের প্রচলিত স্থান-কাল-ক্রেতার সীমানার দেয়ার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। গড়ে তুলেছে ভার্চুয়াল বাণিজ্যের সীমাহীন এক দিগন্ত। বিশ্বের যেকোনো দেশে এখন ঘরে ঘরেই গড়ে উঠছে শিল্প-বাণিজ্যের অদৃশ্য সব মেগা কারখানা। কি শিক্ষার্থী, কি গৃহীনি কিংবা ঘরে বাইরের যে কেউই এখন যুক্ত হচ্ছেন নতুন এই ভার্চুয়াল বাণিজ্যে।

তথ্যমতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিশ্বব্যাপী সক্রিয় রয়েছেন তিনশ কোটির বেশি ব্যবহারকারী। যা গোটা বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। বিশাল আকারের এসব ব্যবহারকারীকে কেন্দ্র করেই বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে ফেসবুক কমার্স বা এফ-কমার্স। যা ইন্টারনেটের সহায়তায় ফেইবুকে পেইজ তৈরির মাধ্যমে ব্যবসা করার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সেবা নেয়ার একটি প্রক্রিয়া। এতে ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে যেকোনো ব্যবসা ব্যক্তিগতভাবে অথবা গ্রুপ আকারে সম্পাদনা করা হয়।

সারাবিশ্বের মতো এফ-কমার্স ব্যবসা বাংলাদেশের তরুণদের কাছে দিন দিন বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশে এফ-কমার্সের সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেশি। কারণ এ খাতে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। মালামাল রাখার জন্য বড় কোনো গুদাম, বিশাল অফিস, যাতায়াতের ঝক্কি, কেনাকাটার জটিলতা থাকে না। ঘরে বসেই দিব্বি নেটওয়ার্কিং সিস্টেমের মধ্যে সহজে ব্যবসা করা যায়। শুধু নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে সরকার এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে পারবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল ইন্টারনেট সংযোগের সঙ্গে ব্যবসা শুরুর জন্য মাত্র ৩০ হাজার টাকার (৩৫০ ডলার) মতো পুঁজি হাতে থাকলেই ব্যবসা শুরু করা যায়। যে কোনো উদ্যোক্তা চাইলেই ফেসবুকে ব্যবসা খুলতে পারেন। যা দেশের ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থান ঘাটতির মধ্যে তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। একইসঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নেও ইতোমধ্যে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে ফেসবুক ভিত্তিক অনলাইন ব্যবসা। বর্তমানে দেশের এফ-কমার্সে যুক্ত উদ্যোক্তাদের মধ্যে অর্ধেকই নারী। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি ঘরে বসেই তারা ফেসবুকে ব্যবসা চালাচ্ছেন। অনেকে আবার চাকরির পরে অবসর সময় কাজে লাগাচ্ছেন বাড়তি আয়ের আশায়।

বাংলাদেশে মূলত দেড় দশক আগে থেকেই প্রায় প্রতিটি সেক্টরকে নিয়ে আসা হচ্ছে ডিজিটালাইজেশন সিস্টেমে। ফলে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধা আগের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী ও সহজ হয়ে এসেছে। এতে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় বাণিজ্যের পথকে সুগম করে জন্ম হয়েছে এফ-কমার্স ইকোসিস্টেমের। দেশে বর্তমান সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এফ-কমার্স ইকোসিস্টেমে দুই হাজার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে সাত হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। এই খাতকে ঘিরে প্রায় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে তিন লাখের বেশি এফ-কমার্স পেজ। এই খাত দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার নুতন দিগন্ত। এখন ঘরে ঘরে গড়ে উঠছে ভাচুর্য়াল কারাখানা। যা ধীরে ধীরে বিপ্লবে রূপ নিচ্ছে।

এফ-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফেসবুক স্টোরগুলো ‘ক্লিক-অ্যান্ড-অর্ডার’ শপিংয়ের সামনে চলে এসেছে। যদিও প্রচলিত মার্কেটপ্লেসের মতো নিবন্ধন নেই বেশিরভাগেরই। পণ্য মজুদ রাখা হয় বাড়িতে। যা ভোক্তাদের কাছে তৃতীয় কোনো লজিস্টিক কোম্পানির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ। মূলত, কোনো ক্রেতা স্টোরগুলো থেকে পণ্য নির্বাচন করেন। অর্থ অনলাইন বা অফলাইন পদ্ধতিতে পরিশোধ করেন। এরপর পণ্যটি ক্রেতার কাছে সরবরাহ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে হঠাৎ ধেয়ে আসা করোনা মহামারী প্রচলিত ব্যবসার গতিপথ একেবারেই পাল্টে দিয়েছে। গেল দুই বছরে করোনাকালে অনলাইন কেনাকাটার দিকে মানুষের ঝোঁক বেড়েছে তুমুলভাবে। এ প্রবণতা আরো বেড়েই চলেছে। তবে এই সুযোগে ব্যবসার মধ্যে নানা জটিলতাও দেখা দিয়েছে। অনেক সময় প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। কখনও ফেসবুকে দেখা পণ্যের সঙ্গে সরবরাহ করা পণ্যের মিল খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। অনেক ক্ষেত্রে আবার অগ্রিম অর্থ পরিশোধের পরেও হাতে পণ্য এসে পৌঁছাচ্ছে না। এফ-কমার্স খাতে নিয়ন্ত্রক কোনো সংস্থা না থাকায় এমন ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়েই চলেছে।

তবে এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এফ-কমার্সের বড় সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, এখাত সম্প্রসারণে আমদানিতে বর্ধিত শুল্ক, আইনি কাঠামো না থাকা, অপর্যাপ্ত ব্যবসায়িক জ্ঞান, পেমেন্ট সিস্টেমের জটিল প্রক্রিয়া ও বৈধ কোনো কাগজপত্র না থাকায় ব্যাংক ঋণ না পাওয়ার মতো কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব সমস্যা সত্ত্বেও হাজার কোটি টাকার বেশি বাজারের এ খাতকে প্রণোদনা দিয়ে আরো সম্প্রসারিত করা সম্ভব। সরকার নজর দিলে বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তালিকার উপরের দিকে থাকা বাংলাদেশে এখাতে বাণিজ্যে বিপ্লব আনতে পারে।

তবে অনেক ব্যবসায়ী তাদের সমস্যার কথা তুলে বলছেন, এফ-কমার্স ব্যবসার নিজস্ব কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। যে কারণে স্থানীয় কুরিয়ার এবং ডেলিভারি পার্টনারদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তৃতীয় পক্ষের পরিবহনের কারণে অতিরিক্ত ডেলিভারি চার্জ বেড়ে পণ্যের কেনাদাম বেড়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছায় না ক্রেতার কাছে। এতে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এফ-কমার্স ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসান সুলতান কাজ করছেন অর্গানিক খাবার নিয়ে। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, প্রতিনিয়তই এ সেক্টরে নতুন নতুন ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মার্কেটিং সিস্টেম তুলনামূলক সহজ হওয়ায় যাচাই-বাচাই করেই পণ্য কিনতে পারছেন ক্রেতারা। এতে ব্যবসার পথ অনেকেটা সুগম হচ্ছে।

প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার মাহমুদুল হাসান সুলতান বলেন, ক্রেতারা সহজে পণ্য কিনতে পারলেও নিয়মনীতি না থাকায় প্রতারিতও হচ্ছেন। ফলে আস্থা খুইয়ে ফেলছেন অনেক ব্যবসায়ী। এ খাতকে নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়ে মাহমুদুল হাসান বলেন, এখাতে দৃষ্টি দেয়া দরকার। আমাদের একটি নীতিমালার আওতায় নিয়ে এলে এফ-কমার্স বিপ্লবের পথ সহজ হবে।

নুরুল হুদা নামের এক এফ-কমার্স ব্যাবসায়ী কাজ করছেন শিশুদের খেলনা ও প্রসাধনী সামগ্রী নিয়ে। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, অধিকাংশ এফ-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আমদানি ভিত্তিক রিসেলার। বেশিরভাগ পণ্য প্রি-অর্ডার ভিত্তিতে বিক্রি হয়। খুচরা আমদানিতে উচ্চ শুল্কের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যা মোটেও নিয়ন্ত্রিত হয় না। এছাড়াও বিক্রেতারা একই পণ্য ভিন্ন দামে বিক্রি করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা। এ সমস্যা সমাধান করা খুবই জরুরি। তা না হলে আমরা যে এফ-কমার্স বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি তা বাস্তবতার মুখ দেখবে না।

চাঁদপুরের রুপালী ইলিশ নিয়ে কাজ করা সুমন হোসেন আনন্দবাজারকে বলেন, গত দুই বছর ধরে আমি ইলিশ নিয়ে কাজ করছি। আমার মতো অনেকেই চাঁদপুরের রুপালী ইলিশ নিজে ফেসবুকে ব্যবসা করছে। আমি গ্রাহকের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি। তুলনামূলক কম দামে ইলিশ বিক্রি করছি ঠিকই কিন্তু পরিবহন খরচের কারণে গ্রাহককে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এছাড়া ভুয়া পেজ খুলে অনেকেই ব্যবসার নামে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। কোনো নীতিমালা না থাকায় তারা এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। এদের নিয়ন্ত্রণে কোনো আইনি কাঠামো নেই। পেজগুলো তদারকি করার জন্য কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষও নেই। ফলে দাম, পণ্য নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রাহকের অভিজ্ঞতার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুপস্থিতিতে, এফ-কমার্স পেজের অপারেটিং সংখ্যার সঠিক তথ্যও নেই। যে কারণে আমরা ক্রেতা হারাচ্ছি। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, এফ-কমার্স নিয়ে আমরা কাজ করছি। খুব শিগগিরই রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা হবে। ই-কমার্সের পাশাপাশি এফ-কমার্স নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আগামী দিনে যারা রেজিস্ট্রেশনের বাইরে গিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে আমরা দেশব্যাপী প্রচারণা চালানোর চিন্তা করছি। আমরা অনলাইন ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফেরাতে সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন