শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৈরী আবহাওয়ায় ধানে চিটা

বৈরী আবহাওয়ায় ধানে চিটা
  • খাদ্য সংকেটে বাড়তি শঙ্কা
  • পরামর্শ আর সেচে ঘাটতিতেই ফলন বিপর্যয়

প্রান্তিক কৃষকদের বড় আবাদ বোরো চাষ। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সারাদেশের মানুষের খাবার উৎপাদন করে কৃষক। সেই কৃষক চলতি বছরের বোরো ধান নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। রোপা আমন দেশের খাদ্যের চাহিদা কিছুটা পূরণ করলেও দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বোরো ধানের ওপর। বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয় রোপা আমন আবাদকে।

নিচু জমিতে রোপা আমন আবাদের কোনো সুযোগ থাকে না। এজন্য বোরো আবাদ দেশের খাদ্য যোগানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চলতি বছরে কাগজ কলমে বাম্পার ফলন হলেও প্রান্তিক কৃষকরা বলছেন ধানে অধিক চিটা হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় ফলনও কম।

ফলে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে ব্যত্যয় ঘটতে পারে। চিটাভরা ধানে গোলা ভরছে না কৃষকদের। তবে ধানের ভেতর কেন এতো চিটা হচ্ছে তার স্পষ্ট ধারণা নেই প্রান্তিক কৃষক বা কৃষি কর্মকর্তাদের কাছে। ধান চিটা হওয়ায় বোরো মৌসুমেই ধানের বাজার চড়া। বর্তমানে ধানের বাজার প্রতি মণ ১১শ থেকে ১২শ টাকা। এরপরও প্রান্তিক কৃষক তাদের উৎপাদিত ধান নিয়ে খুশি না। চলতি বছরের বোরো মৌসুমে দীর্ঘমেয়াদি খরা, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শের ঘাটতি ও অপ্রতুল পানি সেচের কারণে ধানের চিটা বেশি হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রান্তিক বোরো চাষিরা। ধানে চিটা ধরায় চরম লোকসানে পড়েছেন প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষিরা।

ক্ষতিগ্রস্ত বোরো চাষিরা জানান, বোরো আবাদের শুরুটা ভালোই চলছিল। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিল এবার ধানের আবাদে বাম্পার ফলন হবে। যথাসময়ে রোদ, অনুকুল আবহাওয়া এমনকি পোকামাকড় কম থাকায় ধানের আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না। সবুজ ধান গাছে ধানের শীষ বের হওয়া শুরু হলে শীষ ছোট হতে থাকে। তখনও কৃষক এটাকে অস্বাভাবিক মনে করেনি। ধান সোনালি হলে কিছুটা চিটা বোঝা যায়। সবশেষে ধান কেটে মাড়াই করলে কৃষক বুঝতে পারে চলতি বছরের ধানে কতোটা চিটা হয়েছে। এতে ধানের ফলন কমে গেছে। কোনো কোনো জমিতে অর্ধেক ধান পেয়েছে কৃষক। প্রান্তিক কৃষকদের ধারণা অতি খরা ও থোড় ধানের ওপর ঝড়-হাওয়া বয়ে যাওয়ায় ধানগাছ নুয়ে পড়ে। এতে চিটার পরিমাণ বেড়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ  করোনায় বেড়েই চলছে মৃতের সংখ্যা, নতুন আক্রান্ত ৩৪১

সরেজমিন জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাকা ধানের ওপর অসময়ে কয়েক দিনের অতি বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমে যায়। আবার নিচু জমিগুলোতে হাঁটু পানি জমে। অনেক ধান আবার পাকার আগেই ঝড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ক্ষেতেই নষ্ট হয়। এ কারণের ধানে চিটা বেশি হয়েছে। কৃষকরা জানিয়েছে, শুকনা সময় বিঘা প্রতি ধান কাটা, আনা ও মাড়াই করতে আটজন শ্রমিক লাগলেও ক্ষেতে পানি থাকায় ১২ জন শ্রমিক লাগছে। শ্রমিকের মূল্যও চড়া। এতে করে কৃষকের সময় ও উৎপাদন খরচ বেশি পড়েছে।

এদিকে, স্থানীয় কৃষকরা জানায়, এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ধান চাষ করতে ধানের বীজ, হাল চাষ, সার, শ্রমিক মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এক বিঘা জমিতে সেচ পাম্প মালিকের ভাগ বাদ দিয়ে প্রায় ১৪ মণ ধান পাওয়া যায়। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ ধানের মূল্য ১১০০ টাকা। এতে করে তিন মাস পরিশ্রম করে কৃষকের তেমন কোনো লাভ থাকছে না। অপর দিকে ধান কাটা মৌসুমে রোদ না থাকা ও দফায় দফায় বৃষ্টির কারণে অনেকের ধান ক্ষেতেই নষ্ট হয়েছে। এতে খাদ্য নিয়ে শঙ্কা হতে পারে।

ধানাকাটা মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ধান গোলায় তুলতে বিঘ্ন হচ্ছে। অপরদিকে অতিরিক্ত শ্রমিক মূল্যের কারণে দিশেহারা কৃষক। সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকির মাধ্যমে কম্বাইন্ড হারবেস্টার দিলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। অপরদিকে, পানি জমে থাকা ক্ষেতে মেশিনের মাধ্যমে ধানা কাটাও যায়নি। সব মিলিয়ে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়েছে তবে উৎপাদন বাড়েনি। ফলে খাদ্যের সংকট হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ভূঞাপুর এলাকার বোরো চাষি আবুল কাশেম. হাশেম আলী ও তারা মিয়া জানান, ধান পাকার আগেই ঝড়-বাতাসে ধানগাছ নুয়ে পড়ে। এরপর ধান কাটা মৌসুমে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে অধিকাংশ নিচু জমিতে পানি জমে। এতে জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়। পানিতে পড়ে থাকা ধান পচে যায়। এতে ধানের উৎপাদনও কমেছে এবং এসব বৈরি আবহাওয়ায় ধানের চিটাও বেড়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ভয় কাটিয়ে জয়

বাসাইলের বোরো চাষি ও স্ক্রিমের স্বত্ত্বাধিকারী এনায়েত করিম বিজয় জানান, চলতি বছরে ধানের ফলন কম হয়েছে। ধানে অধিক পরিমাণ চিটা হওয়ার কারণেই উৎপাদন কমে এসেছে। গতবছরের তুলনায় চলতি বছরে প্রতি ১০০ মন ধানে কমপক্ষে ২০ মণ ধান কম হয়েছে। শ্রমিকে বাড়তি মজুরি আর উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রান্তিক কৃষক হতাশায়।

দেলদুয়ারের বোরো চাষি নাছির মিয়া জানান, তার ৮০ শতাংশ জমিতে ১২ মণ ধান পেয়েছেন। যা অন্য বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। তার ধারণা চিটা হওয়া কারণে জমিতে বোরো ফলন কমেছে। এ অঞ্চলের বোরো স্কিমের স্বত্বাধিকারী আরিফুর রহমান মিয়া জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বোরো উৎপাদন কম হয়েছে। চিটাই এর প্রধান কারণ বলে মনে হচ্ছে। সদর উপজেলার বোরো চাষি ইনছান আলী বলেন, এবারে বোরোর উৎপাদন কম। শ্রমিকের মূল্য বেশি। ফলে প্রতি বিঘা জমিতে তার প্রায় ৩ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।

স্থানীয় কৃষিবিদ (কৃষক) শাকিল আহম্মেদ শুভ জানান, মূলত অতিমাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলে ধানে অধিক চিটা হয়। এক্ষেত্রে ইউরিয়ার পাশাপাশি পটাশ বা অন্যান কম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ধানের কান্ড মজবুত হয়। ফলে বাতাসে ধান গাছ নুয়ে পড়ে না। চিটার পরিমাণও কম হয়। এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে পানির ঘাটতি পড়লেও ধানে অতিমাত্রায় চিটা হয়। অনেক সময় ধানের জমিতে পানির অভাব হয়। এ কারণে ধানে চিটা হয়। মাজরা পোকার আক্রমণেও ধানে চিটা হয়। সেক্ষেত্রে ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে।

কুশি অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ চললে জমিতে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হবে। তাছাড়া থোড় ও ফুল ফোটা স্তরে অতিরিক্ত ঠান্ডা থাকলেও ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানি রাখলে চিটার পরিমাণ কমানো যায়। অতি আক্রমণকাতর জাতের আবাদ পরিহার করা বা অবস্থার প্রেক্ষাপটে কৃষক আবাদ অব্যাহত রাখলে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি পরিমিত ইউরিয়া সার ও পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  বন্যায় গোখাদ্য সংকট, বিপাকে খামারি

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় এক লাখ ৭১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে চাষ হয়েছে এক লাখ ৭২ হাজার ৫৫৩ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২৪ হাজার টন। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কথার সঙ্গে প্রান্তিক কৃষকদের তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কথা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক আহসানুল বাসার বলেন, চলতি মৌসুমে বোরোর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। রোগ ও পোকার আক্রমণ ছিলো না বললেই চলে। আশা করি ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ পর্যন্ত ধান কর্তন প্রায় শেষের দিকে। অন্যান্য বছরের তুলনায় শ্রমিকের মূল্য বেশি হওয়ায় কৃষকরা একটু সমস্যার মধ্যে পড়েছে। এ বছর জেলায় ব্রি-৮৯ ও ব্রি-৯২ জাতের ধান যোগ হয়েছে। এতে ফলন ৫ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া শিগগিরই বঙ্গবন্ধু-১০০ নামে নতুন জাতের ধানও যোগ হচ্ছে। চিটা ধানের বিষয়ে তিনি বলেন ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধানে কিছু চিটা হয়েছে। অন্যকোনো জাতে তেমন চিটা হয়নি।

সরকারের নির্দেশনায় আগামী বছর থেকে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ প্রজাতির ধানের পরিবর্তে ব্রি-৮৯ ও ব্রি-৯২ ও বঙ্গবন্ধু-১০০ প্রজাতির ধান চাষের কথা ভাবছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ৫০ শতাংশ ভর্তুক্তিতে ৫০টি কোম্বাইন হারভেস্টার মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। সে গুলো ধান কাটার কাজেই ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়াও আশেপাশের জেলা থেকে মেশিন এনে ধান কাটা হচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন