শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভয় কাটিয়ে জয়

সর্বনাশা-রাক্ষুসে নদী জয় করে গৌরবগাথা

‘সন্ধ্যা হইলেই একাকী নদীতীরে আসিয়া বসিতাম। ছোট ছোট তরঙ্গগুলি তীরভূমিতে আছড়াইয়া পড়িয়া কুলু কুলু গীত গাহিয়া অবিশ্রান্ত চলিয়া যাইত; যখন অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া আসিত এবং বাহিরের কোলাহল একে একে নীরব হইয়া যাইত তখন নদীর সেই কুলু কুলু ধ্বনির মধ্যে কত কথাই শুনিতে পাইতাম! কখন মনে হইত, এই যে অজস্র জলধারা প্রতিদিন চলিয়া যাইতেছে ইহা তো কখনও ফিরে না; তবে এই অনন্ত স্রোত কোথা হইতে আসিতেছে? ইহার কি শেষ নাই? নদীকে জিজ্ঞাসা করিতাম ‘তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?’ নদী উত্তর করিত ‘মহাদেবের জটা হইতে’।…

প্রমত্তা পদ্মার পাড়ে বসে এমন ভাবনায় ডুবে যেতেন মুন্সীগঞ্জের রাঢ়িখালে জন্ম নেয়া বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। ছেলেবেলার পদ্মার সেই স্মৃতি তিনি লিখে গেছেন ‘অব্যক্ত’ বইয়ের ‘ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে’ গল্পটিতে। স্মৃতিচারণমূলক সেই গল্পে তিনি আরও লিখেছেন,..একদিন আমি বলিলাম, ‘নদী, আজ বহুকাল অবধি তোমার সহিত আমার সখ্য। পুরাতনের মধ্যে কেবল তুমি! বাল্যকাল হইতে এ পর্যন্ত তুমি আমার জীবন বেষ্টন করিয়া আছ, আমার জীবনের এক অংশ হইয়া গিয়াছ; তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ, জানি না। আমি তোমার প্রবাহ অবলম্বন করিয়া তোমার উৎপত্তি-স্থান দেখিয়া আসিব’।

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর ছেলেবেলার অপার কৌতুহলের সেই পদ্মার (গঙ্গা) উৎপত্তি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে। হিমালয় থেকে গঙ্গা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করে। এরপর মেঘনার সঙ্গে মিশে মেঘনা নামে গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। আজ থেকে প্রায় পৌনে দুশ বছর আগের সেই পদ্মা আজও বহমান। আজও পড়ের মানুষের কাছে বড় বিস্ময়ের। আজও কৌতুহল আর ভয় জাগিয়ে দেয় দু’পাড়ের মানুষের মনে। পদ্মার সঙ্গে পাড়ের মানুষের অন্যরকম সখ্য গড়ে উঠলেও নদীটির হিংস্ররূপ ছাড় দেয় না কাউকেই।

আরও পড়ুনঃ  ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন পদ্মা সেতু

প্রাচীনকাল থেকেই প্রবাহমান পদ্মা সর্বগ্রাসী। বয়ে যাওয়ার সময় যেমন পাড় ভাঙে তেমনি ঘরবাড়িও গিলে ফেলে। প্রতিবছর নদীর করাল গ্রাসে কত শত একর বিলীন হয়, ঘরহারা হয় কত মানুষ। এই সর্বনাশা নদীর ভাঙনের মুখে পড়ে ধ্বংস বাংলার ইতিহাসের বহুল আলোচিত বিক্রমপুরের রাজা রাজবল্লভের কীর্তি। সেই থেকে পদ্মা খ্যাত হয় কীর্তিনাশা হিসেবে।

বিভিন্ন সূত্রমতে, বিশ্বের সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হলো পদ্মা। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসার গবেষণাতেও তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবছর প্রবল ভাঙনে শত শত একর ফসলি জমি আর ঘরবাড়ি গিলে ফেলে পদ্মা। ভয় আর আতঙ্ক নিয়েই দিন কাটে পদ্মাপাড়ের জনপদের মানুষের। সেজন্যই পদ্মার আরেক নাম রাক্ষুসে নদী। যুগ যুগ ধরে পদ্মার সর্বগ্রাসী সেই রূপ উঠে এসেছে ইতিহাসে, শিল্প-সাহিত্যে কখনও সুরের আবহে। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের গান, নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে/ এইতো নদীর খেলা/ সকাল বেলা আমির যে ভাই/ ফকির সন্ধ্যা বেলা…। কিংবা পল্লীকবি জসীম উদ্ দীনের গান, মাঝি বাইয়া যাও রে/ অকূল দরিয়ার মাঝে/ আমার ভাঙা নাও রে..; যেন পদ্মার সর্বনাশা রূপেরই বর্ণনা।

প্রখ্যাত গীতিকার আব্দুল লতিফের কথা ও সুরে কিংবদন্তি শিল্প আব্দুল আলীমের কণ্ঠের সেই গান, সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই/ বল আমারে তোর কি রে আর/ কুল কিনারা নাই, কুল কিনারা নাই/ পাড়ির আশায় তাড়াতাড়ি/ সকাল বেলা ধরলাম পাড়ি/ আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো/ তবু না কুল পাই… পদ্মার সর্বনাশা রূপকেই বর্ণনা করে। অন্যদিকে, আবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গান, পদ্মার ঢেউ রে–/ মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে/ এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙা পা/ আমি হারায়েছি তা’রে… বিরহের যাতনাই প্রকাশ করে।

আরও পড়ুনঃ  রাঙ্গুনিয়া থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ছনের মাটির ঘর

প্রাচীন চীনে হুয়াংহো নদী সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেত বলে নদীর নাম হয়ে যায় চীনের দুঃখ। পরবর্তী সময়ে চীন সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর প্রযুক্তির সহায়তায় সেই দুঃখকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে সর্বনাশা পদ্মাকে বশে আনা বরাবরই কঠিন। বেপরোয়া ভাঙন প্রবণতা আর গভীরতা নদী শাসনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ। আর সে কারণে উপকূলীয় ২১ জেলা তথা দক্ষিণাঞ্চল একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে উত্তরাঞ্চল আর মধ্যাঞ্চল থেকে।

যুগের পর যুগ ধরে ভয়ঙ্কর স্রোত আর বিপজ্জনক নৌরুটের কারণে পদ্মা পাড়ি দেয়া সত্যিই ভয়াবহ ছিল। এপাড় ওপারের জীবন যে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছিল বছরের পর বচর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নৌরুটের সক্ষমতা বাড়লেও ঝুঁকি আর কমছিল না। প্রতিবছরই বড় দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে নৌপথে। এতে পদ্মা পারাপারে নৌযান হয়ে পড়েছিল সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বাহন। রাক্ষুসে পদ্মার করাল গ্রাসে বছরের পর বছর ধরে তীরবর্তী মানুষ সর্বস্ব হারালেও গত কয়েক বছরে স্বপ্ন আর বড় আশার বার্তা দিয়ে এসেছে পদ্মা সেতু। আজ সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু দুই পাড়ের মানুষের রাক্ষুসে নদী পারাপারের ভয়-আতঙ্ক দূর করে দেয়ার জন্য উন্মুক্ত।

যুগ যুগ ধরেই মানুষ বহতা নদীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। জয় করেছে ভয় আর পারাপারের বিপদ। বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর ইতিহাস অনেক লম্বা। তবে সর্বনাশা পদ্মায় সেতু নির্মাণ ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নদীর চরিত্র, প্রকৃতি আর দুপাড়ের ভৌগোলিক অবস্থান বিচার করে পদ্মা সেতু বিশ্বের বিস্ময়। বিশেষ করে দেশীয় অর্থায়নে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ শুধু পদ্মাকে জয়ই নয়, একই সঙ্গে গৌরব আর আত্মবিশ্বাস অর্জনেরও।

আরও পড়ুনঃ  করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এমএ হক

সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা পদ্মার সেই চেহারার বদল ঘটেছে। বদল ঘটেছে পাড়ের মানুষের মননেও। নদী যতই ভয়ঙ্কর আর সর্বগ্রাসী হোক না কেন, মানুষ চাইলে তা জয় করতে পারে। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয় নদীর উন্মত্ততা। পদ্মা সেতু শুধু অর্থনীতির বদলই ঘটাচ্ছে না, দুই পাড় তথা নদী অববাহিকার বাসিন্দাদের মনে চিরকালিন সেই ভয় আর আতঙ্ক দূর করে দিচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর তাই পাড়ে গিয়ে এখন শিল্পীরা ভয়কে জয় করে বিজয়ের সুর ছড়াচ্ছেন। নদীমাতৃক দেশটিতে নদী যেন আরও আপন আরও নিবিড় সম্পর্কে বাঁধা পড়লো অববাহিকার বাসিন্দাদের কাছে। মনস্তাত্ত্বিক এই পরিবর্তনও পদ্মা সেতুর বড় কৃতিত্ব।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন