শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিবেশের হুমকি চা-শিল্পে

পরিবেশের হুমকি চা-শিল্পে

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষিখাতসহ বিভিন্নখাতের উৎপাদনের ওপর। বাংলাদেশেও কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ছে। এতে উৎপাদন যেমন কমে আসছে তেমনি আগ্রহ হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। দেশের এমনই একটা খাত চা। বিশ্বে উৎপাদনে দশম স্থানে ও রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চা শিল্পে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের অংশ হিসেবে দেশে বনভূমি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে চা উৎপাদনে।

লাভজনক হওয়ার কারণে এক সময় দেশের বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা চা বাগান তৈরিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করতেন। এতে সারাদেশে চা চাষের সম্প্রসারণ ঘটে। পাহাড় থেকে শুরু করে সমতলেও চায়ের আবাদ করা শুরু হয়। দেশের দ্বিতীয় রপ্তানি পণ্য হিসেবে সে সময় চায়ের ব্যবসা ছিল শিল্পপতিদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। যার ধারাবাহিকতায় ইস্পাহানি, এইচআরসি, ইসলাম, ট্রান্সকম, হা-মীম গ্রুপসহ বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান চায়ের দেশ সিলেটে চা বাগান তৈরিতে বিনিয়োগ করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই চিত্রের খানিকটা বদল ঘটেছে।

চায়ের নতুন বাগান তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন উদ্যোক্তারা। দেশের শিল্পপতি কিংবা ব্যবসায়ীরা আর নতুন চা বাগানে বিনিয়োগ করছেন না। তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গেল এক দশক ধরেই দেশে অতিরিক্ত খরতাপ, অনাবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। সেই সঙ্গে দেশে পরিবেশের ওপর আগ্রসন শুরু হয়েছে। যে কারণে দিন দিন বনভূমি কমে যাচ্ছে। এর ওপর উত্তরাঞ্চলে অপরিকল্পিত চায়ের চাষাবাদ হচ্ছে। যাতে বাজার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। উৎপাদিত চায়ের প্রকৃত দাম না পাওয়ার মূল্য না পাওয়ায় নতুন বাগান করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

আরও পড়ুনঃ  সোনালি আঁশে সুবাতাস

উদ্যোক্তারা বলছেন, কেবল চায়ের নতুন বাগান করার বিষয়ই নয়, বরং চা-শিল্পকে ঠিকিয়ে রাখতে গেলে প্রকৃত দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। চায়ের বাজার ব্যবস্থাপনা আর দাম না পাওয়ার সমস্যা দূর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে চা শিল্পকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার দাবি তুলছেন বাগানমালিকরা। তারা বলছেন, চায়ের উৎপাদন খরচ কমাতে সার আর কীটনাশকের ভর্তুকি বাড়াতে হবে। তা না হলে বিদ্যমান বাগান মালিকরাও ধীরে ধীরে বাগান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এতে লাভজনক চা-শিল্পের সম্প্রসারণ থেমে যাবে।

সূত্রমতে, বৃটিশ শাসনামলে ১৮৩৪ সালের দিকে সিলেটে চায়ের চাষাবাদ শুরু হয়। পরে চট্টগ্রাম জেলায় তা সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক চা বাগানের সংখ্যা ১৬৬টি। এর মধ্যে শুধু সিলেট অঞ্চলেই চা বাগানের সংখ্যা ১৩৭টি। আর চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলসহ মৌলভীবাজার জেলায় আছে ৫৮টি বাগান। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) সূত্রমতে, বিগত ২০২০-২১ চা মৌসুমে দেশে ৯৫ দশমিক ৬০ মিলিয়ন কেজি এবং ২০২১-২২ মৌসুমে ৯৬ দশমিক ৭০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়। যা এখন পর্যন্ত দেশে চায়ের সর্বোচ্চ উৎপাদন রেকর্ড।

ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) শিবলী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশে বর্তমানে চায়ের চাষ সম্প্রসারণে বড় বাধা প্রয়োজনীয় টিলা তথা বনভূমির অভাব। পাশাপাশি চায়ের বাজার মূল্য এখন অনেক কম। তিনি আরোও জানান, উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড় জেলায় চায়ের চাষ হয় ধানের মতো ব্যক্তিপর্যায়ে। সেখানের চাষিরা ধান হয় না এমন কৃষি জমিতে চা লাগিয়ে কাঁচি (কাস্তে) দিয়ে তা কাটে। এতে তাদের উৎপাদন খরচ কম হয়। এসব চায়ের গুণগত মান নিম্নপর্যায়ের হওয়ায় ১৫০-৬০ টাকা কেজি দরে তা বিক্রি করে দেয়। যে কারণে আমরা চায়ের প্রকৃত মূল্য পাই না।

আরও পড়ুনঃ  ডিমে শীতল ছোঁয়া

বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন নর্থ সিলেট ভ্যালির চেয়ারম্যান এবং খাদিম টি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) নোমান হায়দার চৌধুরী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশে এখন ভারতীয় চায়ের বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় চায়ের প্রকৃত দাম পাওয়া যায় না। ফলে মালিকপক্ষ এখন আর চা চাষে আগ্রহী হয় না। নোমান হায়দার চৌধুরী বলেন, চা চাষে প্রচুর ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএস পি), মিউরেট অব পটাস (এমওপি) সার ছাড়াও কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। তবে বাজারে এসব সারের প্রচুর দাম। তাই চা চাষকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিলে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে। তখন মালিকপক্ষ চা চাষে আগ্রহী হবে।

বাংলাদেশ টি রিচার্স ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) শ্রীমঙ্গলের পরিচালক মোহাম্মদ আলী দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, দেশে চায়ের চাষ সম্প্রসারণে বড় বাধা জমি। চায়ের জন্য প্রয়োজন টিলা জমি যেখানে থাকবে প্রখর রৌদ্র আর অতি বৃষ্টি। পাশাপাশি কম তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করছে। রোদ আর বৃষ্টির কোনো হিসাব না থাকায় চা চাষে শঙ্কা দেখা গেছে।

উত্তরাঞ্চলের অপরিকল্পিত চায়ের চাষ বিষয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, উত্তরাঞ্চলে চা চাষ হচ্ছে কৃষি উৎপাদনের মতো। সেখানে চাষিরা নিজেদের পরিত্যক্ত জমিতে চায়ের চাষ করছেন। তাদের প্রশিক্ষণ দিলেও তারা ধানের মতো কাঁচি দিয়ে চা গাছের আগা কেটে বিভিন্ন মিলে বিক্রি করছে। ফলে চায়ের গুণগত মান বজায় থাকছে না। পাশাপাশি বাজারে চায়ের দর পড়ে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন