শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মরুর তাপে শ্রমিক উধাও

মরুর তাপে শ্রমিক উধাও

মাঠের পর মাঠ জুড়ে ধান। শুধু ঘরে তোলার অপেক্ষা। আবহাওয়ার বৈরিতায় শঙ্কা বাড়ছে। সকালে রোদ তো বিকেলে ঝড়-বৃষ্টি। ইতোমধ্যে অনেক অঞ্চলে কাল-বৈশাখীর তাণ্ডবে মাটিতে শুয়ে পড়েছে বোরো ধান। এর মধ্যেই আবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক অঞ্চলে এর প্রভাবে বৃষ্টি ঝরেছে। আরো বৃষ্টির শঙ্কায় সোনার ধান ঘরে তোলা নিয়ে চাষিদের প্রতিটি নিঃশ্বাস কাটছে উৎকণ্ঠায়।

বৈরি আবহাওয়ার শঙ্কার ওপর নতুন করে চেপে বসেছে চরম শ্রমিক সংকট। মরুকরণের দিকে ধেয়ে চলে বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে ধানকাটার তাড়া থাকলেও শ্রমিক মিলছে না। যাও আবার মিলছে তারও চুক্তিমূল্য চড়া। কয়েকদিন আগেই বরেন্দ্র অঞ্চলে শুরু হয়েছে বোরো ধান কাটাই-মাড়াই উৎসব। তবে শুরুতেই দেখা দিয়েছে শ্রমিক সঙ্কট। অতিরিক্ত পরিশ্রমিক কিংবা বেশি ধান দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন চাষিরা।

চাষিরা বলছেন, বরেন্দ্র অঞ্চল ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে। একদিকে ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে দিন দিন তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। এমন মরু আবহাওয়ার মাঠে কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সেজন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের বেশিরভাগ শ্রমিকই এখন শহরমুখী। শহরে অল্প খাটুনিতে আয় বেশি। সে কারণে কৃষিখাতে শ্রমিক সংকট দিন দিন বাড়ছে।

এসব কারণে ধানের উৎপাদন মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। ধান চাষে যে খরচ হচ্ছে, ধান বিক্রি করে তা আর উঠে আসছে না। এমন চলতে থাকলে আগামীতে বোরো চাষ কমতে থাকবে। স্থানীয়রা বলছেন, এমনিতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্র পানির সংকট। যে কারণে সেচের খরচ দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে আবার শ্রমিক সংকট দেখা দিয়ে ধান চাষ থেকে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

আরও পড়ুনঃ  বৃহস্পতিবার থেকে ধরা যাবে ইলিশ

রাজশাহী কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী ৬৫ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। মাঠে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ হাজার ৯৮৫ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এবারে ৭২ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এছাড়াও বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবঞ্জ জেলার আবাদ হচ্ছে আরো সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে।

নওগাঁর পোরশা উপজেলার শুড়িপুকুর গ্রামের অনেক চাষি মাঠে পাকা ধান নিয়ে অপেক্ষা করছেন শ্রমিকের জন্য। এখানকার চাষি ডাবলু জানান, মাঠে ধান পেকেছে। কিন্তু শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। রাজশাহীর তানোর উপজেলার প্রকাশনগর গ্রামের কৃষক সামসুজোহা জানান, তিনি এবার ২৮ বিঘা জমিতে বোরো চাষাবাদ করেছেন। এর মধ্যেই কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ক্ষেতের ধান মাটি হেলে পড়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ধান ঘরে তুলতে না পারলে ধানের রঙ নষ্ট হয়ে যাবে। বাজারে দাম পাওয়া যাবে না।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌর এলাকার পাঁচন্দর গ্রামেক কৃষক মাসুম আলী। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চলতি বছর দুই বিঘায় বোরো ধান চাষ করেছিলেন। ঝড়ে ইতোমধ্যেই ধান মাটিতে শুয়ে গেছে। এভাবে বেশিদিন থাকলে জমিতেই ধান নষ্ট হয়ে যাবে। ক্ষেতে বোরো ধান নিয়ে এমন বিপদে শুধু কৃষক মাসুম আলী একাই নয়, বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর উপজেলা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় অনেক জায়গায় কালবৈশাখীর তাণ্ডবে কৃষক মাসুম আলীর মতো হাজার হাজার কৃষক সমস্যায় পড়েছেন শ্রমিক সংকটের কারণে।

আরও পড়ুনঃ  কেনিয়ায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা

বরেন্দ্রের অনেক এলাকায় ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য প্রতিমণে শ্রমিকদের দিতে হচ্ছে ৮ থেকে ১০ কেজি ধান। প্রতি বিঘায় যদি ২৮ মণ ধান হয় তাহলে ৭ মণ ধানই দিতে হবে শ্রমিকদের। এতে চাষিরা লাভের মুখ দেখতে পারবে না বলে আশঙ্কা করছেন। আবার কোথাও কোথাও টাকা চুক্তিতে শ্রমিক মিললেও এক বেলার জন্য একজন শ্রমিকের জন্য অর্থ গুনতে হচ্ছে ৪০০ টাকা।

বরেন্দ্রের মাঠে মাঠে দেখা যায় যারা অল্প জমি (১ থেকে ২ বিঘা) চাষ করেছেন তারা শ্রমিকের আশা না করে নিজেরাই ধান কাটতে শুরু করেছেন। তবে যারা বেশি জমিতে ধান চাষ করেছেন তারা পড়েছেন বিপাকে। শ্রমিক ছাড়া তারা ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। নওগাঁর পোরশা উপজেলার রঘুনাথপুর এলাকার শ্যামা। ২ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। শ্রমিক সংকটের কারণে নিজেই ধান কাটা শুরু করেছেন।

রাজশাহীর পাশের উপজেলা গোদাগাড়ী। সেখান থেকে শ্রমিকরা রাজশাহীতে আসেন। প্রতিদিন শহরে কোনো কোনো কাজ করে সন্ধ্যায় ফিরে যান গ্রামে। এমন এক শ্রমিক গুপিন হাঁসদা। তিনি বলেন, মাঠে প্রচুর গরম। ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ খুব কষ্টের। সে কারণে আগে ধান কাটার কাজ করলেও এখন আর করেন না। প্রতিদিন শহরে যান। সারাদিন কাজ করে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পান। সন্ধ্যায় গাড়িতে চেপে ফিরে আসেন বাড়িতে। সারামাস কাজ করে ধান কিনে নিয়ে চালের চাহিদা পুরণ করা হয়।

রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার কয়েক জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, কালবৈশাখী কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের কিছু ধান মাটিতে হেলে পড়েছে। দ্রুত সময়ে ধান কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। দেরি হলে জমিতে হেলে পড়া ধানে গাছ বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে কৃষকেরা লোকসানে পড়তে পারে।

আরও পড়ুনঃ  টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের স্বাদ পেতে চায় টাইগাররা

তবে কৃষিবিদরা দাবি করেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে শুরুতেই শ্রমিক সংকট ছিল। গত কয়দিন আবহাওয়া ভালো থাকলে শ্রমিক সংকট থাকবে না। কারণ, বিভিন্ন জেলা থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতি বছর শ্রমিকরা আসে ধান কাটা ও মাড়াই করার জন্য।

রাজশাহীতে তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মেদ বলেন, ঈদের তিন দিন আগেই কৃষকদের সচতেন করতে ম্যাসেজ দেয়া হয়েছিল। ঈদের দিন বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া হতে পারে বলে। অনেক কৃষক তা আমলে নেন নাই। তবে ঈদের দিন ঝড়ো হাওয়া বৃষ্টি হয়েছে এতে বোরো ধানের কিছুটা ফলন কমতে পারে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন