শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ত্যাগীদের বাদ পড়ার অভিযোগ

ঢাবির নীল দলে গণতন্ত্রের আড়ালে গ্রুপিং

ঢাবির নীল দলে গণতন্ত্রের আড়ালে গ্রুপিং

ত্যাগীদের বাদ দিয়ে অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কমযোগ্যতা সম্পন্ন ও বিতর্কিতদের নেতা বানানো রীতি যেন থামছেই না দেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ সমর্থিত ঢাবি শিক্ষকদের সংগঠন নীলদলের মধ্যে। সর্বশেষ নীল দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটিকে ঘিরে ফের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের বিষয়টি সামনে এসেছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে সংগঠনের জ্যেষ্ঠ ও ত্যাগী নেতা-সমর্থকদের মধ্যে।

সূত্র জানায়, নীল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক পদের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ অনেকদিন ধরেই সংগঠনের অভ্যন্তরে চলছে আলোচনা। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি ঢাবির এ. এফ. মুজিবুর রহমান গনিত ভবনে নীল দলের এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দলের আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক পদের জন্য শিক্ষকদের নাম প্রস্তাব করা হয়। ওই সভায় অধিকংশ শিক্ষকেই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে অথবা সাধারণ সভায় সমর্থকদের ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের পক্ষে মত দেন। পরবর্তী সময়ে দলের শীর্ষ পদে কারা আসবেন তা নিয়ে বেশ কয়েকবার আহ্বায়ক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ গত ২৯ ও ৩০ মার্চ আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক পদে যাদের নাম প্রস্তাব হয়েছিলো তাদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায়ও আলোচনার মধ্যে দিয়ে যোগ্য কমিটি গঠনের বিষয়ে মতামত দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের মতামতকে উপেক্ষা করে এবং প্রাথীদের আগে থেকে কিছু না জানিয়ে পরদিন হুট করে আহ্বায়ক কমিটির সভা ডাকা হয় এবং আহ্বায়ক কমিটির সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে তিনজন নির্বাচিত হয়। এতে সংগঠনের আহ্বায়ক পদে ফার্মেসী অনুষদের ডিন অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাসার, যুগ্ম আহ্বাবায়ক পদে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আমজাদ আলী ও শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম বিজয়ী হয়েছেন। তবে, নেতা নির্বাচনের এ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-সমর্থকরা।

আরও পড়ুনঃ  ২৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগে অনিশ্চয়তা!

শিক্ষকদের দাবি, কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্যদের ভোটে নীল দলের শীর্ষ পদ নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হ‌লেও তা ক‌য়েক বছর আ‌গ পর্যন্ত অনুসৃত হয়‌নি। ঢাবি শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপিংয়ের কারণে অনেক সময় বিতর্কিতরাও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে আসে। এবারের নির্বাচনে সংগঠনের জ্যেষ্ঠ ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে তড়িগড়ি করে এ নির্বাচন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষকরা জানান, সংগঠনের সাধারণ সভায় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে অথবা সাধারণ সভায় সমর্থকদের ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের পক্ষে অধিকাংশ শিক্ষক মত দেন। তবে, সাধারণ শিক্ষকদের এদাবি না মেনে আহ্বায়ক কমিটির সদসদের ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক পদে অন্তত ১৪ জনের ও যুগ্ম আহ্বায়ক পদে অন্তত ৩৯ জনের নাম প্রস্তাব হয়। তাদের মধ্যে, অনেকে রয়েছে যারা দীর্ঘদিন ধরে নীল দলের সাথে যুক্ত ও ওয়ান ইলিভেনের প্রতিকূল সময়ে সংগঠনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হওয়ায় গ্রুপিংয়ের কারণে তারা বাদ পড়েছেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, সমঝোতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন হবে সাধারণ সভায় আমাদের এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। কিন্তু তারা ভোটে নির্বাচন করেছে। আমরা বলেছি যদি ভোট করতে হয় তাহলে সাধারণ সভায় হবে। কিন্তু আমাদের কথা মানা হয়নি। আহ্ববায়ক কমিটিতে ৪০ জনের মতো লোক। কিন্তু সাধারণ সদস্য অনেক। সম্মিলিত আলোচনা ভিত্তিতে আমরা বলেছিলাম। তারা নামে মাত্র একদিন বসছে। হুট করে ভোট করে নেতৃত্ব নির্বাচন করেছে।

আরও পড়ুনঃ  শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিমাসে ১৫ জিবি ফ্রি ডেটা দেবে চবি

জানা যায়, সর্বশেষ ঢাবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন ঘিরেও সংগঠনের অভ্যন্তরে ভোটের মাধ্যমে নীলদলের প্রতিনিধি নির্বাচনের কথা উঠলে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এসময় নীল দলের সদস্যরা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্যানেল ঘোষণা করে। এক পর্যায়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের প্রতিনিধি ঘোষণা করা হয়।

এদিকে, নির্বাচিত প্রার্থীরা বিতর্কিত ও সংগঠনের শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকান্ড অভিযুক্ত বলে জানিছেন সংগঠনের একাধিক শিক্ষক। তাদের অভিযোগ, ঢাবির টিএসসিতে অনুষ্ঠিত নীল দলেন এক সভায় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিনকে শারীরিকভাবে প্রহার করেছেন নির্বাচিত আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার। এছাড়া, যুগ্ম আহ্বায়ক আমজাদ আলীর বিরুদ্ধে বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে ওই সময়ের স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের সুপারিশে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে এই অভিযোগের কারণে তৎকালীর উপাচার্য তাকে প্রক্টর পদে স্থায়ী করেননি। পরে বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বে আসলে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষক বলেন, ‘ওই ঘটনায় সীতেশ চন্দ্র বাছারের লাথি, কিল ঘুষিতে জামাল উদ্দিনের নাক থেকে রক্ত ঝড়তে দেখেছি। তিনি ওই সময়ে সেখান থেকে উপাচার্যের বাসায় গিয়ে নালিশ করেছেন।’ অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল পন্থী বলে জানা গেছে।

এদিকে ভিন্ন কথা বলেছেন সংগঠনের বর্তমান দায়িত্বে থাকা নেতৃবৃন্দ। তাদের দাবি, সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য সমঝোতার কথা উঠলে তারা সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, সদস্যরা সমঝোতায় পোঁছাতে না পারায় তারা ভোটের দারস্ত হয়েছেন।

আরও পড়ুনঃ  রংপুরে মেস ভাড়া ভোগান্তিতে মালিকদের মানবিক হওয়ার আহ্বান

এ বিষয়ে সংগঠনের যুগ্ম আহ্ববায়ক অধ্যাপক মো. আবদুর রহিম বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য বেশ কয়েকবার মিটিং করেছি। যারা প্রার্থী ছিলো তাদের নিয়ে আলাদাভাবে বসেছি। কিন্তু কেউ নাম প্রত্যাহার করেনি। প্রার্থীরা সমঝোতায় না আসায় আমাদের গণতান্ত্রিক পক্রিয়ায় যেতে হয়েছে।’
সংগঠনের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. আব্দুস ছামাদ বলেন, ‘সমঝোতার জন্য বহু চেষ্টা ও মিটিং করা হয়েছে। কোন প্রার্থী প্রত্যাহার না করায় আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গিয়েছি।’

সাধারণ সভায় ভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাধারণ সভায় কখনও ভোট হয়নি। সবসময় আহ্বায়ক কমিটিতে ভোট হয়। আমি নিজেও আহ্বায়ক কমিটির ভোটের মাধ্যমে হয়েছি।’ ত‌বে সম‌ঝোতার মাধ্যমে শিক্ষক স‌মি‌তি প্রার্থী ম‌নোনয়‌নের বিষয়‌টি উল্লেখ করে সী‌মিত সদ্যসদের নি‌য়ে ভোটা‌ভো‌টির বি‌রোধীতা ক‌রেছেন নীল দ‌লের জ্যেষ্ঠ ও ত্যাগী নেতারা।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন