শিক্ষাখাতে বরাদ্দ থেকে সরাসরি যে রিটার্ন পাওয়া যায় পরোক্ষ রিটার্ন তার চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য শিক্ষার সাথে অন্য খাতের তুলনা চলে না। কেননা কৃষি, শিল্প, পর্যটন বা এ ধরনের খাতগুলোতে বছর শেষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট এবং পরিমাপযোগ্য দ্ব্যর্থহীন হিসেব পেলেও শিক্ষায় তা পাওয়া যায় না।
‘বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দের গতিধারা ও তার পরিণতি’ শীর্ষক সেমিনারে এ কথা বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম।
আফরোজান্নাহার রাশেদার সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এম এম আকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরি গায়েন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল্লাহ ভুঁইয়া, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাংগঠনি সম্পাদক অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি পতিত পাবন প্রমুখ।
গত শনিবার বিকাল ৪টায় রাজধানী ঢাকার পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির শিক্ষক শাখা সেমিনারটির আয়োজন করে।
ড. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশের মোট উৎপাদিত সম্পদের ৬-৭ শতাংশ সম্পদ শিক্ষায় ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে ইউনেস্কো। এমনকি বিশেষজ্ঞরা এ খাতে বরাদ্দের বিষয়ে প্রচলিত আন্তঃখাত তুলনাকে অগ্রাহ্য করে দেশের সুদূর প্রসারি স্বপ্নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের সামর্থ অনুযায়ী বরাদ্দের উপদেশ দেন।
তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশে জবাবদিহিমূলক সরকার না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কেননা শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও কাঁচি এখানেই বেশি নির্দয় হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনা করতে গিয়ে জানান,
২০১৯ সালে আফগানিস্তানেও জিডিপির ৩.২ শতাংশ বরাদ্দ ছিল সেখানে বাংলাদেশের ছিল ১.৩ শতাংশ। আর ২০১০ সালে কিউবা দিয়েছিল ১২.৮ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। এ সময়ে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশই ৪ শতাংশ হারে ব্যয় করেছে। সবকিছু উর্ধ্বমুখি হলেও শিক্ষাবাজেটে নিম্নমুখি বাংলাদেশে। কেননা ২০০০ সালে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল ২০.৪৯ শতাংশ। এটি ২২ বছরে শুধুই কমেছে। ২০১৯ সালে ছিল ৯.২৭ শতাংশ।
তিনি বলেন, শিক্ষাকে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মাদরাসা, কিন্ডার গার্টেন ও সাধারণ শিক্ষা চালু রেখে তিন ধরনের প্রজন্ম তৈরি করছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চিন্তাই ছিল এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করবো। কিন্তু হয়নি।
ড. তাজুল ইসলাম সাধারণ শিক্ষার মানের ক্রমাবনতিতে বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিশ্বাসযোগ্যতার বাইরে পাশের হার এবং জিপিএর সংখ্যা বাড়ছে তা নিয়ে সরকারে বিভিন্ন পর্যায়ে আত্মতুষ্টির বন্যা বইছে। অথচ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আশঙ্কাজনকভাবে মেধাশূন্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
তিনি বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি সামান্য কর্তব্যবোধ থাকলে তার সর্বোত্তম বাস্তবায়ন ঘটানো যায় শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে। তাই শিক্ষা আন্দোলন কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি বা সংগঠনের অন্যতম কর্মসূচি হওয়ার দাবি রাখে।
ড. এম এম আকাশ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে আমাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলন করতে হবে। একটি নিয়ে আন্দোলন করলে হবে না। কারণ খারাপ শিক্ষকের ছাত্র খারাপই হবে পর্যায়ক্রমে। আমরা চাই উন্নত ও সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা। তিনি বলেন, শিক্ষাখাতে সুশাসন আনতে হবে। কারণ যে সরকার আছে সে তো কারিকুলাম করবে না। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন করবে। এটি অনুযায়ী তার পদ মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে বলেন, এম এম আকাশ।
অধ্যাপক ড. কাবেরি গায়েন বলেন, ২০২১ অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৬৯ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। গত বছর জিডিপি ছিল ২ শতাংশ সেটি এবার ১.৮ শতাংশ দিয়েছে। যুক্তরাজ্যে ৬.৪ শতাংশ। আমাদের গবেষণায় এক টাকাও বরাদ্দ নেই। এমনকি গবেষণার জন্য কোন একাউন্টও নেই। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী স্কলারশিপ চালু হওয়ায় কিছুটা অর্থ পাচ্ছে। অথচ হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাতেই বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, করোনায় দুই তৃতাংশ শিক্ষার্থীও পাওয়া যায়নি ক্লাসে। টেকনিক্যাল শিক্ষায় জড়িতদের অবস্থা আরো খারাপ। এক সময় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হবে।
ড. কাবেরি গায়েন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গণনচুম্বি ভবন হলেও গবেষণায় অর্থায়ন নেই। অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল্লাহ ভুঁইয়া বলেন, শিক্ষকদের গবেষণার করতে বইয়ের তাকও নিজের কিনতে হয়। রাষ্ট্র সেনাবাহিনী, পুলিশদের বন্দুক দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বই বা অর্থ দেয় না। শিক্ষকদের গবেষণায় ৯ পয়সাও দেয় না রাষ্ট্র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেওয়ারিশ বানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, কারিকুলাম ও সিলেবাস এখনো হয়নি। যে শিক্ষার কারিকুলাম নেই তা দিয়ে জাতি কতদূর? শিক্ষকদের কোয়ালিটি ইনশিউর করা সম্ভব হয়নি।
আকমল হোসেন বলেন, কারিগরি শিক্ষাকে এখনো মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়নি। প্রকল্পের নামে অবকাঠামোতে দুর্নীতি হচ্ছে। একজন ক্যাডেট শিক্ষার্থীর ব্যয় ১৯ জন সাধারণ শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি। পতিত পাবন বলেন, দরিদ্রসীমার নিচের ছেলে-মেয়েরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ২৫ ভাগ শিক্ষার্থীদের বাড়িতে টিভি আছে, ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন ছিল। এই অনলাইন শিক্ষা ১ শতাংশও কাজ হয়নি। আমাদের উপবৃত্তি নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে।
আনন্দবাজার/শহক