শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফের তেলের চাপ

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির ঢেউয়ের দুই দফা ধাক্কা সামলে বিশ্বঅর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ঠিক সে সময়েই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নতুন করে চাপ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ খাতসহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলছে।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির ঢেউয়ের দুই দফা ধাক্কা সামলে বিশ্বঅর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ঠিক সে সময়েই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নতুন করে চাপ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ খাতসহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলছে। জীবনযাত্রা, শিল্পখাতসহ বাণিজ্য সম্প্রসারণেও বাধা সৃষ্টি করছে। তাৎক্ষণিকভাবে তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে পরিবহন বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে নিত্যপণ্যের বাজারেও পড়ছে এর প্রভাব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল, কোরোসিনের দাম বাড়ার কারণে বিশ্বব্যাপী ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। আয় বাড়াতে সক্ষম না হলে তারা বাধ্য হয়ে ব্যয় সংকোচন শুরু করে। এতে ভোগ ব্যয় দারুণভাবে কমে যায়। যার কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হতে থাকে। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে থাকে। করোনার দুই দফার ধাক্কায় এমনিতেই দেশে দেশে বেকারত্ব, নতুন দারিদ্র্যে সাধারণ আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। তার ওপর বাজারে ভোগ্য বা নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষুধার কষ্টও শুরু হয়েছে। এর ওপর আবারো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে।

মূলত, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাজারে তেলের দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল। দেশে দেশে লকডাউনের সময় চাহিদা কমেছিল জ্বালানি তেলের। তখন তেল উত্তোলনকারী দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে দৈনিক মোট সরবরাহের ১০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ইতিহাসের সর্বনিন্ম মাইসান ৩৭ ডলারের নিচে নেমে যায়।

তবে বিধিনিষেধ শিথিলের পরে চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। নতুন বছর ২০২২ সালের প্রথম সপ্তাহের মতো দ্বিতীয় সপ্তাহেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে বড় উত্থান হয়েছে। বলা যায়, ২০১৪ সালের অক্টোবরের পর অর্থাৎ প্রায় সাত বছর তিন মাস পর সর্বোচ্চ দামে উঠে এসেছে জ্বালানি তেল। এর আগে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নিলে ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল বিশ্ববাজারে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতনের মধ্যে পড়ে তেল। সেদিন প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ঋণাত্মক ৩৭ ডলারের নিচে নেমে যায়। রেকর্ড এই দরপতনের পরেই অবশ্যই তেলের দাম বাড়তে থাকে। এতে রেকর্ড দরপতনের ধকল সামলে ২০২০ সালের বেশিরভাগ সময় প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৪০ ডলারে আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

আরও পড়ুনঃ  সাগরে ইলিশ নদীতে হাহাকার

তবে বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়া এবং লিবিয়ার তেল উত্তোলন বৃদ্ধি পাওয়ায় মাঝে বিশ্ববাজারে তেলের বড় দরপতন হয়। ২০২০ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অপরিশোধিত ও ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম প্রায় ১০ শতাংশ কমে যায়। তবে এই পতনের ধকল কাটিয়ে ওই বছরের নভেম্বর থেকে আবার তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। তবে বিদায়ী বছরের জুন থেকে তেলের দাম বৃদ্ধির প্রবণতায় নতুন হাওয়া লাগে।

২০১৮ সালের অক্টোবরের পর গত বছরের জুনে করোনার প্রকোপের মধ্যে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল ৭৫ ডলারে উঠে আসে। জ্বালানি তেলের এই দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে পরের কয়েক মাস। এতে গত বছরের অক্টোবরে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৮০ ডলার স্পর্শ করে। যার মাধ্যমে ২০১৪ সালের নভেম্বরের পর আবারও অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল ৮০ ডলারের দেখা পায়। ফলে গত বছরের অক্টোবরের শেষদিকে এসে বিশ্ববাজারে তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। যার জন্য বিগত বছরের ৩ নভেম্বর দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ায় সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়া নিয়ে শঙ্কা বাড়ে মূলত অক্টোবর থেকেই। এর আগের সাত বছর তেলের দাম ছিল অনেক কম। তখন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কম দামে তেল কিনে দেশের ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই সাত বছরে সরকার মাত্র একবার দাম কমায়, তাও মাত্র ৩ টাকা প্রতি লিটারে। কিন্তু দাম বাড়তে শুরু করার এক মাসের মধ্যেই বিপিসির দেওয়া প্রস্তাব মেনে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়িয়ে দেয় সরকার। পরে নভেম্বরের পরে দাম কমলের সরকার আর দাম না কমিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এরমধ্যেই আবার তেলের দাম বাড়লো।

আরও পড়ুনঃ  ঝিনাইদহে কমতে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম

মূলত, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের সময়ে তেলের দাম বাড়ানোর সমর্থন নেই কারোরই। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে গাড়ির ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের এই দাম বাড়ার সমালোচনা করা হয় বিভিন্ন পক্ষ থেকে। সেই সঙ্গে গাড়ি ভাড়া বাড়ানোরও সমালোচনা হয়। এ পরিস্থিতিতে গত বছরের ৬ নভেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে দেশেও দাম কমানো হবে। তিনি বলেছিলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। আমরা জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিলিয়ে সমন্বয় করেছি। ভারতসহ সারা বিশ্বে দাম বৃদ্ধি এবং পাচার ঠেকাতেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দুই দফা করোনার ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি তখন অর্থনীতিতে নতুন চাপ তৈরি করেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙা হয়ে উঠেছে। সেই সুবাদে সচল হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তা ব্যাহত হতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি একটি স্পর্শকাতর পণ্য। যার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অর্থনীতিতে সূদরপ্রসারী। জীবনযাত্রাকে এটি নানাভাবে প্রভাবিত করে। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে পরিবহণ ভাড়া। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ে বাস, ট্রাক, কভার্ড ভ্যানের ভাড়ায়। লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বেড়ে যায়। দাম বাড়ার প্রথম প্রভাব পড়ে কৃষকের ওপর, দ্বিতীয় পড়ে পণ্য পরিবহনের ওপর। কৃষকরা একটা বড় খরচ করে সেচ কাজে। বর্তমানে কৃষিখাতে ডিজেলের ব্যবহার ১৬ শতাংশ। সেখানে ডিজেল ব্যবহার করে। ট্রাক কিংবা নৌযানের ভাড়া বেড়ে গেলে শাক-সবজি থেকে শুরু করে যে সব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে, তার সবেরই দাম বাড়ে। ফলে ভোক্তারা ওপর অতিরিক্ত একটা চাপ তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  পাহাড় ধসে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন