কে না চিনে আটিয়া গ্রাম। ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে দেশীয় মুদ্রা সংস্করণে দশ টাকার নোটের প্রচ্ছেদে স্থান পাওয়া চারশ’ বছরের পুরনো মসজিদটির গ্রাম আটিয়া। পাশেই রয়েছে শাহান শাহ আদম (কাশ্মিরী) মাজার শরীফ। এজন্য গ্রামটির পরিচিতি দেশব্যাপী।
এবার যোগ হয়েছে পাঙ্গাস চাষ। তবে আটিয়া গ্রাম নতুন করে পাঙ্গাসের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া গ্রামের পাঙ্গাস মাছের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়ি-বাড়ি পুকুর। ঘরে-ঘরে পাঙ্গাস চাষী। পুকুর ভরা পাঙ্গাস। পাঙ্গাসের গ্রামের সবাই এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। পুকুরের মাটি ও পানির গুণগত মান এবং পুষ্টিকর খাবারে উৎপাদিত পাঙ্গাস জেলার মানুষের আস্থা কুঁড়িয়েছে। জেলার নিন্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের আমিষের চাহিদা পুরণ করছে আটিয়ার পাঙ্গাস।
১৯৯৪ সালে আসাদুজ্জামান আসাদ নামে একব্যক্তি প্রথম আটিয়াতে পাঙ্গাস মাছ চাষ শুরু করেন। আসাদের সফলতায় উৎসাহিত হয়ে আটিয়ার ঘরে-ঘরে তৈরি হয়েছে পাঙ্গাস চাষী। এ গ্রামে প্রায় দেড় শতাধিক পুকুরে এখন পাঙ্গাসের চাষ হচ্ছে। পোনা মজুদ, পাঙ্গাস চাষ, মাছ ধরা, এমনকি বাজারে বিক্রি করাকে কেন্দ্র করে গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাঙ্গাস চাষের সঙ্গে যুক্ত। দুইযুগের পাঙ্গাস চাষে গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।
তবে গত কয়েক বছরে ধাপে-ধাপে বেড়ে খাবারের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় পাঙ্গাস চাষের আগামী দিনগুলো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। খাবারের দাম কমানো, মাছ সরবরাহের ব্যবস্থাসহ সরকারি পৃষ্টপোষকতা এ মুহূর্তে জরুরী বলে মনে করছেন গ্রামের পাঙ্গাস চাষীরা। পাঙ্গাস চাষী আসাদের এখন চারটি পুকুর। দুইটিতে ৩০ হাজার পাঙ্গাস চাষ করেন। বাকি দুইটি পুকুরে পাঙ্গাসের পোনা মজুদ রাখেন।
তিনি বলেন, আমি প্রথম এ গ্রামে পাঙ্গাস চাষ শুরু করি। গ্রামে এখন দেড় শতাধিক পুকুরে পাঙ্গাস চাষ হচ্ছে। বর্তমানে খাবারের দাম দ্বিগুণ। ৭শ থেকে ৮শ‘ টাকা মূল্যের খাবারের বস্তা হয়েছে ১৭ থেকে ১৮শ টাকা। মাছের দাম আগের মতোই রয়েছে। পাঙ্গাস চাষে দুইবার সেরা চাষীর পুরস্কার পেলেও বর্তমানে পাঙ্গাস চাষ নিয়ে হতাশায় রয়েছেন আসাদ।
আসাদের পর ১৯৯৯ সালে পাঙ্গাস চাষ শুরু করেন বায়েজিদ হোসেন জুয়েল। তার চারটি পুকুরে ১৫ থেকে ২০ হাজার পাঙ্গাস পালন করেন তিনি। জুয়েলও জানালেন মাছের খাবারের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কথা। ৩২ থেকে ৩৪ টাকা কেজির খাবার হয়েছে ৫২ থেকে ৫৩শ’ টাকা। প্রতি কেজিতে ১৯ থেকে ২০টাকা মূল্য বেড়েছে। খাবারের দাম কমানোর দাবি জানান এ পাঙ্গাস চাষীও।
ডা. লুতফর রহমান ও জায়েদুর রহমানেরা সাত ভাই মিলে ৬টি পুকুরে পাঙ্গাস চাষ করেন। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডা. লুতফর রহমান নিয়েছেন বিকল্প পদ্ধতি। খাবারের সব ধরনের কাঁচামাল কিনে কারখানা থেকে ভাঙিয়ে নেন। ফলে মাছের খাবারের উর্ধ্বগতিতেও লাভের হিসেব আগের মতোই গুণছেন তিনি। কয়েকজন আবার বাড়িতে খাবার তৈরির জন্য ছোট আকারের মেশিন নিজেই ক্রয় করেছেন। তাদের খাবার খরচ আরও কমে এসেছে। তবে বেকায়দায় পড়েছে যেসব চাষীরা প্যাকেটজাত খাবার খাওয়ায়।
খায়রুল হোসেন বাচ্চুও চারটি পুকুরে পাঙ্গাস চাষ করছেন। দীর্ঘদিন ধরে পাঙ্গাস চাষ করে অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনলেও বর্তমানে খাবারে দাম বেড়ে যাওয়ায় হোঁচট খাচ্ছেন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা নারী ঝর্ণাও শুরু করেন পাঙ্গাস চাষ। বেঁচে থাকা অবস্থায় স্বামীর কাছ খেকে শিখেছিলেন কিভাবে পাঙ্গাস চাষ করতে হয়। মাছ চাষ করেই দুই মেয়ের বিয়ের খরচ যুগিয়েছেন তিনি। বাকি দুজনের ভরণ পোষণের জন্য মাছ চাষ ছাড়েননি এখনও।
ঝর্ণার মতো গ্রামের অনেকেই পাঙ্গাস চাষে ঝুঁকছেন। ফলে এ গ্রামে বেকারত্ব নেই বললেই চলে। সবাই এখন স্বাবলম্বী। প্রতি হাজার পাঙ্গাস চাষ করে বছরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা উপার্জন করেছেন চাষীরা। একজন চাষী ২৫ থেকে ৩৫ হাজার পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের অর্থনৈতিক চাকা বদলে দিয়েছেন।
একদিকে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছে, অন্যদিকে গ্রামের অর্থনীতিকে মজবুত করেছেন। মাছের বর্তমান পাইকারী বিক্রয় মূল্য মণপ্রতি ৪ হাজার খেকে ৪ হাজার ২শ’ টাকা। পাঙ্গাস চাষে খাবারের দাম দফায়-দফায় বেড়ে দ্বিগুণ হলেও মাছের পাইকারি দাম কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১০৫ টাকার মধ্যেই থাকছে। সম্প্রতি চাষীরা ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হচ্ছে। খাবারের দাম না কমলে পাঙ্গাস চাষ থেকে ছিটকে পড়বে চাষীরা এমনটাই ভাবছেন এ পেশার সাথে সম্পৃক্তরা। প্রয়োজন খাবারের দাম কমানো। প্রয়োজন সরকারি সহেযোগিতা।
দেলদুয়ার উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান জানান, আটিয়ার পাঙ্গাস প্রসিদ্ধ। পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমরা সাধ্যমতো পাঙ্গাস চাষীদের সহযোগিতা করছি। প্রশিক্ষণসহ নানা পরামর্শ দিয়ে মৎস্য অফিস সবসময় এসব মাছ চাষীদের পাশে আছে।
আনন্দবাজার/এম.আর
