শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলোয় সয়াবিন সংকট

আলোয় সয়াবিন সংকট

ঈদ ঘিরে কেনাকাটার ভরপুর উৎসবের মধ্যেই হঠাৎ করেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় সয়াবিন তেল। সারাদেশের ভোক্তাদের মধ্যে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় ওঠে। ঈদে আগের দিনে দোকানগুলোতে তেল কিনতে গিয়ে ফিরে আসতে হয় সাধারণ ক্রেতাদের। এমনকি ঈদের রোস্ট তৈরির জন্য যে পরিমাণ সয়াবিন দরকার হয় তা জোগার করতে না পারায় অনেক পরিবারে রোস্ট খাওয়া কমিয়ে দেয়া হয়। এমন চতুর্মুখী সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়েন ক্রেতারা।

ঈদের ছুটির পর গত ৫ মে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফাচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক বার্তায় ভোজ্যতেলের নতুন দর ঘোষণা করা হয়। এতে সয়াবিন তেল লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়। দাম বাড়ার আগে থেকেই বাজার থেকে উধাও হওয়া সয়াবিনের দাম বাড়ার কারণে সংকট ভয়াবহ আকার ধারন করে। ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হওয়া সয়াবিন নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করতে শুরু করেন মিল মালিক, ব্যবসায়ী আর খুচরা বিক্রেতারা।

তবে ‘নতুন দরের’ তেল কোম্পানিগুলো বাজারজাত শুরু করার আগে দোকানিরা পুরনো তেলই বাড়তি দামে বিক্রি শুরু করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোঝাই যাচ্ছে তেলের এই সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি। মূলত অসৎ ব্যবসায়ীরাই তেল মজুত করে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এবং মিলাররাও একই সুরে কথা বলছেন। গত চার মাসে তৃতীয়বারের মতো ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর কারণ জানাতে গণমাধ্যমের সামনে আসেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

মন্ত্রী বলেন, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কারচুপির কারণে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়েছে এবং দামও বেড়েছে। তবে বাজারে সয়াবিন তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।

গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভোজ্যতেলের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এসব কথা জানান। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভোজ্যতেল আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর অন্যতম সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, এস আলম গ্রুপের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সালাউদ্দিন আহমেদ, টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিকুল আথহার তাসলিম এবং বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষসহ অন্যরা।

আরও পড়ুনঃ  করোনাতেও চমক পুঁজিবাজারে

সভায় মন্ত্রী জানান, দেশে ভোজ্যতেল নিয়ে যারা সংকট তৈরি করেছেন তারা চিহ্নিত হয়েছেন। এই ব্যবসায়ীদের তথ্য প্রকাশ করা হবে বলেও জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। টিপু মুনশি বলেন, বাজারে সয়াবিন সংকট কেন তৈরি হলো, আমরা তা খুঁজে পেয়েছি। এই কারচুপি বড় গ্রুপের কেউ করেনি। করেছে ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। যারা কারসাজি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। ডিলারশিপ বাতিল করতে মালিকদের বলেছি। জেলা–উপজেলা পর্যায়ে অভিযান চলবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হবে।

সভায় সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, তেলের দাম বাড়ছে এবং বাজারে তেল নেই, এটার জন্য মিলমালিক দায়ী নন। তেল বাজারে আছে, তেল বাজার থেকে শেষ হয়ে যায়নি। হঠাৎ করে গত ৫ মে তেলের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তে বাজারের খুচরা বিক্রেতারা সংকট সৃষ্টি করেছেন। ফজলুর রহমান আরও বলেন, পর্যাপ্ত তেলের মজুত আছে। তেলের সংকট তৈরি করেছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। দু–এক দিনের মধ্যে বাজারে তেলের সরবরাহ আরও সহজ হবে।

এ সময় ভোজ্যতেল নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়েন সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান। প্রতিষ্ঠানটি তীর ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বাজারে সরবরাহ করে থাকে। সাংবাদিকরা তার দেয়া একটি উত্তরের প্রতিবাদ জানান। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ সাংবাদিকদের নিবৃত্ত করেন।

তেলের দাম ‘অস্বাভাবিক হারে’ বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে, আমাদের দেশেও বাড়বে, এটা অংক। বাংলাদেশ নিজে তেল উৎপাদন করে না উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ তেল দেশে উৎপাদন হয়। তাও বাদাম তেল, সরিষাসহ সব মিলিয়ে। বাকি ৯০ শতাংশ নির্ভরযোগ্যতাই আমদানির ওপরে।’

আরও পড়ুনঃ  চা রপ্তানিতে শঙ্কা

এ সময় মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কয়েকদিন ধরেই তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাগে আন্তর্জাতিকভাবেই যে তেলের দাম বেড়েছে, প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে তেলের দামের একটি তুলনামূলক চিত্র কেউ দেখাচ্ছেন না। মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ও ভোগান্তি হ্রাসে ১১০ টাকা লিটারে সয়াবিন তেল বিক্রি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি, আগামী জুন থেকে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের কাছে ওই একই দামে তেল দেবে বলে ঘোষণা দেয় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

একদিকে বাজারে যখন তেলের সংকট তখন একের পর এক গুদামে অভিযান চালিয়ে তেলের মজুদ আবিষ্কার করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আগের মজুত করা বোতলজাত সয়াবিন বি‌ক্রি হ‌চ্ছে বে‌শি দা‌মে। দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে একই চিত্রের দেখা মিলছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বি‌শেষ অভিযান চালিয়ে এরকমই প্রমাণ পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত রবিবার চট্টগ্রামে এক ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে এক হাজার ৫০ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় ফজলুর করিম পাটোয়ারী নামে এক ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে ৫৭ হাজার লিটার মজুত সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এভাবে একের পর এক তেল উদ্ধারের খবর আসতে থাকে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের প্রশংসা করে মন্ত্রী বলেন, ভোক্তা অধিকার আমাদের সাহায্য করছে। এত হাজার হাজার ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছানো মুশকিল। যেখানে যেখানে সম্ভব আমরা চেষ্টা করছি।

আরও পড়ুনঃ  ১৯শে আগস্ট থেকে চলবে সব গণপরিবহণ

এদিকে ভোক্তা সাধারণকে জিম্মি করে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস)। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মূল্য আদায়কারীদের বিরুদ্ধে গতানুগতিক অভিযানের পরিবর্তে প্রচলিত আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারপূর্বক বিচারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান সিসিএসের নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বোতলজাত সয়াবিন প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা ও খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে মিল মালিকরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে। তারা প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে গেলেও সরকার তাতে সায় দেয়নি।

এরপর তেলের আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের পর ঈদুল ফিতরের আগে মার্চের মাঝামাঝিতে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা করে কমানো হয়। এতে গত এপ্রিল ও মের শুরুতে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেন মিল মালিকরা। অন্যদিকে দাম বাড়ার আশায় তেলের মজুদ গড়ে তোলেন ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতারা। অবৈধ মজুদ ঠেকাতে অভিযান শুরু করে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

উল্লেখ্য, নতুন দর অনুযায়ী, প্রতি লিটার সয়াবিন ১৮০ টাকা করা হয়েছে। বোতলজাত সয়াবিন প্রতি লিটার ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়েছে। ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা। শতকরা হারে পাম তেলের দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ। আর সয়াবিনের দাম খুচরায় বেড়েছে ২৮ শতাংশ, বোতলজাতের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন