- টানা দুই বছর বিশ্বে শীর্ষস্থান অর্জন
- দশ বছরে সর্বোচ্চ লেনদেন
- বিদেশি বিনিয়োগে দেশে দেশে রোডশো
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে করোনার (কোভিড-১৯) নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও চমক দেখায় দেশের পুঁজিবাজার। বছরজুড়ে প্রতিদিনই পুঁজিবাজারে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসে। সেই সঙ্গে সেকেন্ডারি পুঁজিবাজারে আসে নতুন সব ধরনের বিনিয়োগকারী। বিদায়ী বছরে বিনিয়োগ বাড়ায় পুঁজিবাজারের লেনদেন বিগত ১০ বছরে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে। একইভাবে লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সূচক।
এতে পুঁজিবাজারের গভীরতা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনী বৃদ্ধি পায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও অভাবনীয় ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে পুঁজিবাজার।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটালের এক প্রতিবেদনে পারফরম্যান্স বিবেচনায় বিশ্বে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে দেশের পুঁজিবাজার। এর আগে গত বছরের জুলাই- সেপ্টেম্বরেও ‘বিশ্বসেরা’ হয় দেশের পুঁজিবাজার।
বিদায়ী বছরের অর্জন সম্পর্কে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ভূইয়া বলেন, দীর্ঘ এক দশক পর নতুন এক রেকর্ড সৃষ্টি করেছে দেশের পুঁজিবাজার। ডিএসইর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। লেনদেনের পাশাপাশি অনেকগুলো কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। আর বেশকিছু কার্যক্রম বিশেষ করে নতুন প্রোডাক্ট ইটিএফ চালু নতুন বছরের শুরুর দিকেই বাস্তবায়িত হবে বলে আমি আশাবাদি। আমরা ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির জন্য দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শুরু করেছি। বিশেষ করে আইটি স্টাটআপ কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এসএমই মার্কেটকে আরো গতিশীল করা হবে।
ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, প্রযুক্তিগত ও আইনগত সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নতুন বছরের প্রথমার্ধেই আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করবো। এর জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এর মধ্যেই শুরু হয়েছে। আশা করি, এসব অর্জন নতুন বছরে পুঁজিবাজারের এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ডিএসইর ৫৪টি নতুন ট্রেক হস্তান্তর দেশের পুঁজিবাজার প্রসারে এক অনন্য উপহার। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন এবং পুরাতনদের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতায় রচিত হবে আগামীদিনের পুঁজিবাজারের শক্তিশালী ভীত। তারল্য সংকটে পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিনিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমে বাজারকে স্বাভাবিক করার লক্ষে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিতরণ না হওয়া লভ্যাংশ নিয়ে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল গঠন করা হয়েছে।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আনুপাতিক হারে শেয়ার বরাদ্দের জন্য এক্সচেঞ্জে ইলেক্ট্রনিক সাবস্ক্রিপশন সিস্টেমের উদ্বোধন করা হয়। এর ফলে ইস্যুয়ার কোম্পানির আইপিও ইস্যু খরচ কমার পাশাপাশি, চাঁদা গ্রহণ থেকে লেনদেন শুরুর মধ্যবর্তী সময় কমে আসে। একই সাথে আইপিও আবেদন, পরীক্ষণ এবং শেয়ার বরাদ্দের ক্ষেত্রে আরও বেশী সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয় এবং একই প্লাটফর্মের মাধ্যমে সব ধরনের স্টেক হোল্ডারদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে।
অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির চিত্র ও পরিবেশ বিনিয়োগের অনুকূল। যার ফলে বাংলাদেশ আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসী বংলাদেশি বিনিয়োগকারী এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্ভাবনাময় পুঁজিবাজার বিষয়ে রোড-শোর শুরু করে। ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারটি অঙ্গরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, লন্ডনে রোড-শো সম্পন্ন করেছে এবং আরো বেশ কয়েকটি দেশে রোড-শোর আয়োজন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
২০২১ সালের পুঁজিবাজারচিত্র
আইপিও- শিল্প উদ্যোক্তারা ২০২১ সালে প্রথমবারের ১টি সুকুক বন্ড ও ১৪টি কোম্পানিসহ মোট ১৫টি কোম্পানি বাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ১৬৫৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৩টি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ২৯৭ কোটি ৭৩ টাকা মূলধন উত্তোলন করে। এছাড়া ৪টি প্রতিষ্ঠান বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। অপরদিক ২০২০ সালে ৮টি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে মোট ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৩টি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ৩১১ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করে।
- লেনদেন
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী স্টক মার্কেটের গতি মন্থর থাকলেও দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইতে সাফল্যের মাইলফলক সৃষ্টি করে। ২০২১ সালে ডিএসইতে ২৪০ কার্যদিবস লেনদেন হয়। এতে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যা ডিএসইর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন এবং গতবছরের চেয়ে ২ লাখ ১৯ হাজার ৭১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বা ১৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। যার গড় লেনদেন ১৪৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। অপরদিক ২০২০ সালে ২০৮ কার্যদিবসে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯৮১ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং গড়ে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৬৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
- ডিএসইর মূল্যসূচক
ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) আগের বছরের চেয়ে এক হাজার ৩৫৪ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট বা ২৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ৭৫৬ দশমিক ৬৬ পয়েন্টে উন্নীত হয়। ২০২১ সালে ডিএসইএক্স মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৩৬৮ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ৫ হাজার ৪৪ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট। ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ৪ হাজার ৯০দশমিক ৪৭ পয়েন্ট নিয়ে এ সূচকের যাত্রা শুরু হয়। এছাড়া ডিএসই৩০ সূচক ৫৬৮ পয়েন্ট বা ২৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৫৩২ দশমিক ৫৮ পয়েন্টে দাঁড়ায়।
২০২১ সালে ডিএস৩০ মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭৮৭ দশমিক ৮২ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ১ হাজার ৯০১ দশমিক ১৩ পয়েন্ট। ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ১ হাজার ৪৭৩ দশমিক শূন্য ১ পয়েন্ট নিয়ে এ সূচকের যাএা শুরু হয়। একই বছর ডিএসইএক্স শরীয়াহ্ সূচক (ডিএসইএস) ১৮৯ দশকি শূন্য ১ পয়েন্ট বা ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৪৩১ দশমিক ১২ পয়েন্টে উন্নীত হয়। ২০২১ সালে ডিএসইএস মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ দশমিক ২৬ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ১ হাজার ১৬৬ দশমিক ১৭ পয়েন্ট। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি ৯৪১ দশমিক ২৮ পয়েন্ট নিয়ে এ সূচকের যাত্রা শুরু হয়।
- পুঁজিবাজার মূলধন
২০২১ সালে বাজার মূলধন ডিএসইর ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ডিএসই বাজার মূলধন আগের বছরের তুলনায় ৯৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে বাজার মূলধন সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ৪ লাখ ৪৩ হাজার কোটি।
- মার্কেট পিই রেশিও
২০২১ সালের শেষে ডিএসইর তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজসমূহের মূল্য আয় অনুপাত বা মার্কেট পিই রেশিও দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ৫৮ পয়েন্টে। খাতওয়ারি সর্বনিম্ন অবস্থানের দিক থেকে মার্কেট পিই ছিল মিউচ্যুয়াল ফান্ডের। যার মার্কেট পিই ৩ দশমিক ৯১, ব্যাংকিং খাতের ৯ দশমিক ৭২, ফুয়েল এন্ড পাওয়ার খাতের ১৩ দশমিক ১৯, টেলিকমিউনিকেশন খাতের ১৬ দশমিক ৯২, ফার্মাসিউটিক্যালস এন্ড কেমিক্যালস খাতের ২০ দশমিক ৭৭, টেক্সটাইল খাতের ২১ দশমিক ৬৫, ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের ২৩ দশমিক ৭০, আর্থিক খাতের ২৪ দশমিক ৯৭, সিমেন্ট খাতের ২৬ দশমিক ৪৭, সার্ভিসেস এন্ড রিয়েল এস্টেট খাতের ২৬ দশমিক ৯২, ইন্স্যুরেন্স খাতের ২৮ দশমিক ১৩, ফুড এন্ড এ্যালাইড প্রোডাক্ট খাতের ৩১ দশমিক ২১, আইটি-খাতের ৩৩ দশমিক শূন্য ৫, বিবিধ খাতের ৫৫ দশমিক ৯৩, ট্রাভেল এন্ড লেইজার ৬০ দশমিক ৫৮, সিরামিক খাতের ৬৭ দশমিক ৩৪, জুট খাতের ৭১ দশমিক ২২, পেপার এন্ড প্রিন্টিং খাতের ৮০ দশমিক ৭২ এবং ট্যানারি খাতের ৮৮ দশমিক ১৯ পয়েন্টে। অপরদিক ২০২০ সালের শেষে সামগ্রিক মার্কেট পিইরেশিও ছিল ১৬ দশমিক ৫১ পয়েন্টে। মার্কেট
ক্যাপিটালাইজেশন টু জিডিপির অনুপাত- ডিএসইর ২০২১ সালে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজগুলোর মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন টু জিডিপির অনুপাত দাঁড়ায় ১৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ মোবাইল লেনদেন বিশ্বায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও বিকাশের ফলে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য মডেল এবং অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রেক্ষাপট ও গতিপ্রকৃতি প্রতিনিয়ত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে৷ পুঁজিবাজারের সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের সাথে তাল মিলিয়ে কোভিড–১৯ পরিস্থিতিতে ডিএসই মোবাইলের মাধ্যমে লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ২০২১ সালে ৭৭ হাজার ৬৪ জনে উন্নিত হয়।
এবছর মোবাইলের মাধ্যমে মোট ১ কোটি ৬৯ লাখ ৮৫ হাজার ৫২টি আদেশ প্রেরণ করে। এর মধ্যে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯২ হাজার ১২৬টি আদেশ কার্যকর হয়। ২০২১ সালে মোবাইলের মাধ্যমে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাড়ায় ৪২ হাজার ৬৮১ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার ২২৮ টাকা। এর মধ্যে ক্রয়ের পরিমাণ ২১ হাজার ৭৮২ কোটি ৬৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৬৬ টাকা এবং বিক্রয়ের পরিমাণ ২০ হাজার ৮৯৮ কোটি ৯২ লাখ ৬ হাজার ৮৬২ টাকা। ডিএসইর লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সর্বোত্তম সুবিধা বিনিয়োগকারীর দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সর্বদা সচেষ্ট।
আনন্দবাজার/শহক