মরিচের আদি নিবাস আমেরিকা মহাদেশ হলেও বর্তমানে বিশ্বের সব দেশেই রান্না ও ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মরিচের নাম ‘লংকা’ বা ‘লঙ্কা’ হওয়ায় অনেকেই মনে করেন শ্রীলঙ্কা থেকে আমদানি করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে থেকেই আমেরিকার আদিবাসীরা মরিচ ব্যবহার করে আসছে। ইকুয়েডরের দক্ষিণ পশ্চিমাংশে পুরাতাত্ত্বিকেরা ছয় হাজার আগে মরিচ চাষের প্রমাণ পেয়েছেন। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অংশে মরিচের চাষ করা হতো প্রাচীন কাল থেকেই।
ইউরোপীয়দের মধ্যে ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে মরিচের দেখা পান। ভারতবর্ষে উৎপন্ন গোল মরিচের মতো ঝাল বলে তিনি এগুলোকে পিপার নাম দেন। অবশ্য গোল মরিচের গাছের সঙ্গে মরিচ গাছের সম্পর্ক নেই। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকে মরিচ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দিয়েগো আলভারেজ চানকা নামের একজন চিকিৎসক কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযানের সময়ে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হতে মরিচ স্পেনে নিয়ে আসেন। তিনি ১৪৯৪ সালে মরিচের ঔষধী গুনাগুণ নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন।
স্পেনীয় ব্যবসায়ীরা মেক্সিকো থেকে মরিচ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়। প্রথমে ফিলিপাইন্স, এবং তার থেকে ভারতবর্ষ, চীন, কোরিয়া, ও জাপানে মরিচ বিস্তার লাভ করে। ঝাল ও স্বাদের জন্য অচিরেই এটা এশিয়ার বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় খাবারের অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হয়।
খাবারের স্বাদ আর সুগন্ধ আনতে মসলার নানাবিধ ব্যবহার দেখা যায়। সারা বিশ্বেই প্রচলিত আছে বিচিত্র সব মসলাপাতি। একেক দেশের খাবারের যে অদ্বিতীয় বিশিষ্ট স্বাদ–গন্ধ পাওয়া যায়, তা অনেকাংশেই এসব মসলা মিশ্রণেরই মহিমা। মসলার কারণেই স্বাদেও চলে আসে ভিন্নতা। আর এসব সমলার মধ্যে মরিচ অতি পরিচিত একটি মসলা। প্রতিবছর মরিচের ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছে।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনডেক্সবক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের মরিচের উৎপাদন ২৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন টন হয়েছে। বাংলাদেশে মরিচ চাষ হয় প্রায় দেড় লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে। মরিচের ফলন হয় প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টনের মতো। বিশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত বাংলা থেকে বিদেশে মরিচ রপ্তানি হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেসব মসলার জন্য ভারতের পূর্বাঞ্চলে এসেছিল, মরিচ তাদের অন্যতম।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে মসলা নিয়ে কাজ করছে ১৯৯৫ সালে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত ‘মসলা গবেষণা কেন্দ্র’। সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশে মসলার চাহিদা বছরে প্রায় ৩২ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন মাত্র ১৮ লাখ টন। বাকি মসলা বিদেশ থেকে আমরদানি করা হয়। সেজন্য দেশে মসলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশাল এই চাহিদা পূরণ করার জন্য মরিচের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
দেশে মরিচের বাজার
বগুড়ার চরাঞ্চলে উৎপাদিত কাঁচামরিচ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। সাত সকালে চাষিরা ক্ষেত থেকে কাঁচা মরিচ তুলে বিক্রির জন্য নিয়ে যান স্থানীয় বাজারে। সেখান থেকে পাইকারদের মাধ্যমে কাঁচা মরিচ কিনছে ঢাকার একাধিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। এরপর সেগুলো প্যাকেটজাত করা হচ্ছে রপ্তানির জন্য।
দেশের অনেক কৃষক শুধু মরিচ উৎপাদন করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামবাংলায় পান্তাভাতের সঙ্গে কাঁচা মরিচ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। তরকারি ও ভর্তা-ভাজির এক অপরিহার্য উপকরণ কাঁচা অথবা শুকনো মরিচ। শুকনো মরিচ গুঁড়া মসলা, সস, চাটনি ও আচারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য মরিচের সস ও আচারের অনেক চাহিদা। তাছাড়া মরিচের অনেক ঔষধি গুণাগুণ আছে।
মরিচের স্থানীয় উল্লেখযোগ্য জাত হলো- বালিজুরী, বোনা, বাইন, ধানি, সাইটা, সূর্যমুখী, পবা, হালদা, শিকারপুরী এবং পাটনাই। তবে মসলা গবেষণা কেন্দ্র বারি মরিচ-১ (বাংলা লংকা), বারি মরিচ-২ ও বারি মরিচ-৩ নামে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় জাতের পাশাপাশি সারাবছর ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয়।
রবিশস্য হিসেবে অধিকাংশ মরিচ ফলানো হয় বগুড়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে। হার্ভার্ড ও চায়নিজ ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ২০১৫ সালে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা সপ্তাহে একদিনের জন্য হলেও মসলাযুক্ত খাবার খান, তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি ১৪ শতাংশ হ্রাস পায়।
তবে শুধু বাঙালিই নয়, কান লাল করা ঝাল মসলা খাবার প্রিয় বিশ্বের অনেক দেশে। তুরস্কের বাসিন্দারা প্রতিদিন গড়ে ৮৬ দশমিক ৫ গ্রাম মরিচ খেয়ে থাকেন। যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো। যারা বছরে ৫০ দশমিক ৯৫ গ্রাম মরিচ খান। যারা বিশেষ করে ঝালমসলাযুক্ত খাবারের জন্য বিখ্যাত।
আনন্দবাজার/শহক